বাড়ি ফিরে জসিম ও আনোয়ারের বাধভাঙা কান্না

চুয়াডাঙ্গার ছোটলুয়ায় সংসারের দৈন্যতা ঘোচাতে পানিপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর স্বপ্ন ধলিসা

 

নজরুল ইসলাম: নির্মম নির্যাতনের শিকার চুয়াডাঙ্গা ছোটসলুয়ার জসিম ও আনোয়ার বাড়ি ফিরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমাদের মতো আর কেউ যেন দালালদের খপ্পরে না পড়ে। কেউ যেন ওইভাবে পানিপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন না দেখে। সৃষ্টিকর্তাকে হাজার শুকরিয়া। ভাগ্যিস বাড়ি ফিরতে পেরেছি।’ এরা সংসারের অভাব-অনটন কাটিয়ে আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার স্বপ্নে একই গ্রামের বিপুলের খপ্পরে পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণা সয়ে কোনো রকম বাড়ি ফিরেছেন। অনাহারে ক’দিনের মধ্যে হাড়ের সাথে প্রায় চামড়া লাগা অবস্থায় বাড়ি ফিরে ৩ মাসের রোমহর্ষক বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবারই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ঝরতে থাকে অশ্রু। মানবপাচারকারীচক্রের আঞ্চলিক হোতা বিপুল অবশ্য বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের ছোটসলুয়া মাঝপাড়ার জাকির হোসেনের ছেলে বিপুল দীর্ঘদিন ধরে আদমব্যবসার সাথে জড়িত। বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নামে এলাকার অনেকের কাছ থেকেই হাতিয়ে নিয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা। সম্প্রতি বিপুলের ফাঁদে পা দিয়ে বেশ কয়েকজন যুবক পড়েছে মহাবিপাকে। মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা নিলেও অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে ফিরেছে বাড়িতে। এবার টানা ৩ মাস সাগরে পানিতে ভেসে খেয়ে না খেয়ে জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরলো ছোলসলুয়া গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে জসিম ও আরজ আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, প্রায় সাড়ে ৩ মাস আগে জসিম ও আনোয়ারকে পানিপথে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর নামে মোটা অঙ্কের টাকা নেয় অভিযুক্ত আদমকারবারী বিপুল। গত ২১ মার্চ আনোয়ার ও জসিমকে সাথে নিয়ে চিটাগাং যায় বিপুল। সেখানে একজন দালালের হেফাজতে দুজনকে রেখে পালিয়ে আসে বিপুল। দালালরা আনোয়ার ও জসিমকে একটি টলারে তোলে। কয়েকদিনের ব্যবধানে পরপর ৫টি টলার পরিবর্তন করে জসিম ও আনোয়ারকে একটি শিপে তোলা হয়। ১ হাজার ১৬ জন মালয়েশিয়া পথযাত্রী ছিলো ওই শিপে। ঠাসাঠাসি করে কোনোভাবে সময় কাটাতে পারলেও তাদের প্রতিদিন খেতে দেয়া হতো ২৫ গ্রাম চালের ভাত, দু ঢোক পানি ও দুটো কাঁচা মরিচ। পানির জন্য ছটফট করলেও সাগরের পানি মুখে তোলার কোনো অবস্থা ছিলো না। কেউ কোনো প্রতিবাদ করলেই বিপত্তি। প্রতিবাদকারীর মারাত্মকভাবে করা হতো শারীরিক নির্যাতন। ৩ মাসে অনেকেই না খেয়ে যেমন মারা গেছে, তেমনি শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ সাগরে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ৩ মাস সাগরের জলে মানবেতর সময় কাটানোর পর মালয়েশিয়ায় পৌঁছায় শিপ। শিপ থেকে নেমে সাগরের পানি সাঁতরে গহীন জঙ্গলে ওঠে সবাই। জঙ্গলের ফলমূল ও গাছগাছালির লতাপাতা খেয়ে কাটে বেশ কয়েকদিন। অবেশেষে মালয়েশিয়া পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় নিজেদের সমর্পণ করে সকলে। আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী মালয়েশিয়ার লঙ্কা বর্ডার ক্যাম্পের পুলিশ যার যার আপন ঠিকানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। জসিম ও আনোয়ার গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। বাড়িতে পৌঁছায় রাত ১০টার দিকে। স্বজনদের কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে জসিম ও আনোয়ার। জসিম ও আনোয়ারের মুখ থেকে রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা শুনে আতকে ওঠে অনেকেই। এদিকে ছেলের সন্ধান না পেয়ে মাসখানেক আগে জসিমের বাবা আলাউদ্দিন বাদী হয়ে বিপুলের বিরুদ্ধে দায়ের করেন মামলা। এ মামলায় অভিযুক্ত বিপুল রয়েছেন জেলহাজতে। তাকে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ গত ১০ মে গ্রেফতার করে।