প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে বিভিন্ন স্থানে বন্যা
স্টাফ রিপোর্টার: প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। অব্যাহত রয়েছে নদীভাঙন। এতে বহু ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ফলে এসব এলাকার পানিবন্দি মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। নদীভাঙনকবলিত ও বানভাসি এসব মানুষ ত্রাণের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কাজ না থাকায় দিনমজুররা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। তবে দু-একটি এলাকায় বন্যার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত কিছুটা কমলেও তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুলছড়ির তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৮ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে সোমবার বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঘাঘট নদীর পানি এ সময় ৫ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে।
অপরদিকে করতোয়ার পানি ৩৯ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি ৯ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যাকবলিত সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর এলাকায় পানিবন্দি লোকজন চরম দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন। ওই সব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া রাস্তা-ঘাটে পানি ওঠায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। ওই চারটি উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে নদীভাঙন অব্যাহত রয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ঢেউটিন ও নগদ অর্থ বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
কুড়িগ্রাম, রৌমারী, ফুলবাড়ী ও নাগেশ্বরী: জেলায় প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। ৬ দিন ধরে নিমজ্জিত আছে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার তীরবর্তী তিন শতাধিক গ্রাম, চর ও দ্বীপচর। বানভাসি এসব মানুষ ত্রাণের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাফুজার রহমান বলেন, রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তায় ১৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পানি কমেছে দুধকুমারে ১৫ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রে ১৩ সেন্টিমিটার ও ধরলায় ১৪ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। ফলে কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী, ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী, রৌমারী ও রাজীবপুরের বিস্তীর্ণ নদ-নদীতীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার কারণে এসব এলাকার সব গ্রামীণ সড়ক ডুবে গেছে। নৌকা ছাড়া যোগাযোগের উপায় নেই এসব এলাকায়। বন্ধ হয়ে গেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দুই শতাধিক ঘরবাড়ি পানির তোড়ে ভেসে গেছে। টানা ৫ দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। অনেকেই ঘরের ভেতর উঁচু মাচায় আশ্রয় নিলেও দেখা দিয়েছে জ্বালানি ও খাদ্য সংকট। পাশাপাশি গো-খাদ্যেরও সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার ফলে প্লাবিত হয়েছে ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বিভিন্ন চর।
নাগেশ্বরী উপজেলার অর্ধশতাধিক চর প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি ইউনিয়নের নিচু এলাকায় ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কুড়িগ্রাম খামারবাড়ি সূত্র জানায়, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ হাজার ২৫২ হেক্টর ফসলি জমি। এর মধ্যে ৪১ হাজার ৪২৫ জন কৃষকের আমন বীজতলা, সবজি খেত, পাটসহ বিভিন্ন ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্রহ্মপুত্র, দশানী ও জিঞ্জিরাম নদীর পানি বৃদ্ধি অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে চলতি বছর বন্যার পদধ্বনি দেখা না দিলেও নদীর তীরবর্তী ২০টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় কয়েক হাজার মানুষ। পানিতে তলিয়ে রয়েছে আমন বীজতলা, সবজি বাগান ও পাটের খেত।
বিভিন্ন উপজেলায় পানি কমতে শুরু করলেও বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রবল বর্ষণ না হলেও অনেক উপজেলায় পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় পানি অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। তবে রাস্তাঘাটে পানি কমায় অনেক উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় সোমবার বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। নতুন করে কোনো এলাকা প্লাবিত হয়নি। পানি কমায় উপজেলার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় চালু হয়েছে। তবে পানি কমলেও কয়েক হাজার হেক্টর আউশ, ইরি ও সবজির জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেছে। কোম্পানানীগঞ্জ ও জাফলংয়ে পানি থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক শ্রমিক। কাজ না থাকায় বর্তমানে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। পানি পুরোপুরি না কমলে তারা কাজে যোগ দিতে পারছেন না। পাথর ব্যবসায়ী ও পাথর বহনকারী যানবাহনের মালিকরাও পড়েছেন বেকায়দায়। গত কয়েক দিনের বিরামহীন বৃষ্টির পাশাপাশি পিয়াইন ও সারী নদী দিয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বেশকিছু এলাকা তলিয়ে যায়। তবে সোমবার থেকে আবার স্বাভাবিক হতে চলেছে এ পরিস্থিতি।
সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে সোমবার পানি ৫ সেন্টিমিটার কমলেও বিপদসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। গোদাখালীতে নির্মাণাধীন বাঁধের ৬১ মিটার অংশ ধসে যাওয়ার স্থান দিয়ে আর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে না। সারিয়াকান্দি ও পার্শ্ববর্তী ধুনট উপজেলায় ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অনেক পরিবার তাদের বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। উপজেলার মরাভিটা সেতুর উত্তর পাশে সংযোগ সড়ক ধসে যাওয়ায় ধুনট উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বন্যাদুর্গতদের মাঝে সোমবার পর্যন্ত সরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়নি। জেলা প্রশাসন তিন টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে। তা এখনও বিতরণ করা হয়নি।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল মোত্তালেব জানান, সারিয়াকান্দি উপজেলার গোদাখালীতে নির্মাণাধীন বাঁধের ধসে যাওয়া প্রায় ৬০ মিটার অংশের মেরামতকাজ শুরু হয়েছে। সোমবার দুপুরে আষাঢ়ের প্রথম দিন ভারি বর্ষণ হয়েছে। শহর, শহরতলি ও বিভিন্ন উপজেলার নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।
নীলফামারীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত শনিবার তিস্তার পানি ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকলেও রোববার সকাল থেকে তা নেমে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমে যাওয়ার কারণে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার তিস্তাপাড়ের নিম্নাঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামে ভাঙন শুরু হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো ইতোমধ্যে নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, তিস্তা নদীর পানি ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারপরও বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের যেন কোনো সমস্যা না হয় সে জন্য সব সময় মনিটরিং করা হচ্ছে।
শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার নিম্নাঞ্চলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যার উন্নতি হয়েছে। মহারশি ও সোমেশ্বরী নদীর পানিও অনেক কমেছে। ঝিনাইগাতী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাদশা জানান, আকস্মিক বন্যার কারণে উপজেলার বেশ কটি গ্রামে ক্ষতি হয়েছে। এসব গ্রামের উজানের পানি কমলেও ভাটি এলাকার নিম্নাঞ্চলের অনেক রাস্তাঘাট ও অনেক সবজি বাগান এখনও পানির নিচে রয়েছে। ঢলের পানির তোড়ে এলাকার কয়েকটি বক্স কালভার্ট ও কাঠের ব্রিজ ও রাস্তা ধসে যাওয়ায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।