কাপড় দিয়ে দু চোখ বেঁধে তোলা হয় টলারে

অবশেষে মায়ের কোলে ফেরা পানিপথে মায়ানমারে পাচারের শিকার আরিফ দিলেন রোমহর্ষক বর্ণনা

 

আলমডাঙ্গা কেদারনগরের এক পিতার আক্ষেপ : এ দেশে গরিবের বিচারের সুযোগ নেই

রহমান মুকুল/শরিফুল ইসলাম রোকন: ‘কক্সবাজারের নিকট এক পাহাড়ের হোটেলে আমাকে রেখেছিলো দু দিন। আমার মতো আরও অনেক ছেলে ছিলো। শেষদিন রাত ২টার দিকে আমাদের হাত পেছনে বেঁধে কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে একটা টলারে তোলে। টলারে করে ছোট জাহাজে তোলে। টলারে থাকতে দালাল অন্যান্যের মতো মারধর করে আমাকে বাপের নিকট মোবাইল ধরিয়ে ৪০ হাজার টাকা পাঠাতে বলেছিলো। তা না হলে হত্যা করবে বলেও হুমকি দিয়েছিলো। আমার বাপ জানতে পেরে আনারুলের নিকট ৪০ হাজার টাকা পৌঁছে দিয়েছিলো। মোট ৪ শ লোক ছিলাম। ১৮ দিন জাহাজে ছিলাম। ২৪ ঘণ্টায় মাত্র একবার এক প্লেট ভাত শুকনো ঝালের গুঁড়ো দিয়ে খেতে দিতো। দিতো মাত্র এক মগ পানি। রাত-দিনে দিতো ২ মগ পানি। তার বেশি কেউ পানি কিংবা ভাত চাইলেই নির্মমভাবে পেটাতো। কাঠের লাঠি দিয়ে বেদম মারধর করতো। বাম পায়ের উরুতে এখনও সে মারের ব্যথা রয়েছে আমার। শরীরের অন্যান্য স্থানেও ব্যথা রয়েছে লাথি আর ঘুষির। খাবারের জন্যে আকুতি করায় এ নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিলো শুধু আমার না, সকলেরই। একজনের ওপর এমন নির্মম অত্যাচার দেখে আর কেউ খাবার কিংবা পানি চাইতো না। মরে গেলেও কেউ সহজে মুখ খুলতো না।’

খুব আস্তে আস্তে উপরোক্ত বর্বণা দিচ্ছিলো মিয়ানমার থেকে উদ্ধার আলমডাঙ্গার কেদারনগর গ্রামের কিশোর আরিফ। সে দরিদ্র সুন্নত আলীর ছেলে। অর্ধাহারে অনাহারে থাইল্যান্ডের নিকট সাগরে টলারে ভাসতে থাকা ১৫০ জন বাংলাদেশির সাথে গত ২১ মে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর সদস্যরা চুয়াডাঙ্গার ৪ জনকে উদ্ধার করে। টিন এজার বলে তাদেরকে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কক্সবাজারের বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর অ্যান্ড কো-অর্ডিনেটর সেলিম আহম্মেদের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে। এরা হলেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার গবরগাড়া গ্রামের মৃত আব্দুর রব ফারাজির ছেলে শফিকুল ইসলাম (১৭), উজলপুর গ্রামের মফিজুর রহমানের ছেলে মোফাজ্জেল হোসেন (১৮), আলমডাঙ্গা উপজেলার কেদারনগর গ্রামের সন্নত আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম (১৮) ও জহুরনগর গ্রামের ফিরোজ মণ্ডলের ছেলে শিমুল (১৯)। পরে তাদেরকে স্ব-স্ব বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়। গতকাল কেদারনগর গিয়ে আরিফের সাথে কথা বলতে গেলে মা-বাবাসহ প্রতিবেশীরা অনেকেই ছুটে আসেন। সে সময় আরিফ জানায়, বেশ কিছুদিন ধরে তার নিজ গ্রামের ওসমানের ছেলে আনারুল ইসলাম তাকে পানিপথে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখায়। ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই যাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত করে সে। এমনকি টাকাও নগদ দিতে হবে না। পরে কাজ করে পরিশোধ করতে হবে বলে জানায়। নিতান্তই বোকা ছাড়া কেউ এমন সুযোগ হাতছাড়া করে না বলেও আনারুল তাকে বার বার প্রলুব্ধ করতো। এরই এক পর্যায়ে আরিফ রাজি হয় মালয়েশিয়া যেতে। প্রায় দেড় মাস পূর্বে দালাল আনারুল তাকে সাথে করে আলমডাঙ্গার ৮ কপাট নামক স্থানে নিয়ে গিয়ে ওসমান নামের আরেক দালালের হাতে তুলে দেয়। ওসমান তাকে সাথে করে প্রথমে ঢাকা ও পরে কক্সবাজার নিয়ে যায়। সেখানে কয়েকদিন অনেক কিশোরের সাথে এক হোটেলে থাকার পরে যখন সে জানতে পারলো পানিপথে বর্তমানে মালয়েশিয়া যাওয়া যাচ্ছে না। সীমান্তও বেশ কড়াকড়ি। বেশ কয়েকজনের সাথে তখন আরিফও বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত দালাল যেতে দেয়নি। বরং তাদেরকে নতুন করে পাহাড়ের এক হোটেলে আটকে রাখে। ২ দিন পর এক রাতে হাত-চোখ বেঁধে জোর করে তোলা হয় টলারে। আরিফ শূন্য দৃষ্টিতে দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে বলে যেতে থাকে- ১৮ দিন ছিলো টলারে চড়ে সাগরে। তারপর মিয়ানমারের জঙ্গলে ২০ দিন পালিয়ে। সেখানে রাখাইন গোত্রের অনেক দালালের হাতে অস্ত্রও রয়েছে। কেউ কথা বললেই লাঠি দিয়ে মারধর করা হতো। সেখানে অর্ধাহারে-অনাহারে ২০ দিন দুর্বিষহ কষ্টে কেটেছে। আরিফ পথের দুঃসহ বর্ণনা দিয়ে বলে,‘বর্ডারে কড়াকড়ির কারণে ভেতরে যাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন তাদেরকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলেও শুনেছিলো সে। কিন্তু এক বার্মিজ মাঝি তাদেরকে রক্ষা করেন, বলেন- এরাও তো মানুষ, আমি এদের ফিরিয়ে দিয়ে যাবো। মিয়ানমারের সাগরের নিকট নিয়ে যান তিনি। পরে ওই বর্মি মাঝি তাদেরকে নৌকায় তুলে দিলে মিয়ানমারের কোস্টগার্ড তাদেরকে উদ্ধার করে সেন্টমার্টিনের নৌকায় উঠিয়ে দেন।              দালাল আনারুল এখন কোথায়? এ কথা জিজ্ঞেস করলে আরিফের বাপ এ দেশে কোনো বিচার নেই বলে ক্ষোভ আর অসহায়ত্বের কথা বলেন। তিনি বলেন, যখন তিনি জানতে পারেন যে আনারুল আর ওসমান দালাল তার ছেলেকে পানিপথে পাচার করেছে, তখন তিনি আনারুলের নিকট ছুটে যান। অথচ নূন্যতম সান্ত্বনা তো দূরে থাক- বরং আনারুলের আত্মীয়স্বজন তাকে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। এতোদিন, এতো অনিশ্চয়তার পর ছেলে ফিরে পেয়ে বরং বেশ আনন্দে আছেন আরিফের মা। দালালের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করবেন কি-না জিজ্ঞেস করলে আরিফের বাবা আক্ষেপ করে বলেন, এ দেশে গরিবের বিচার নাই।

Leave a comment