লোভে ফেলে পাচার নয়, বন্দি করে মুক্তিপণ আদায়

 

ওরা মানব পাচারকারী নয়, প্রতারক। বিদেশে পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে কৌশলে ডেকে নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতারকচক্র তাদের ডেরায় বন্দি করে। এরপর আদায় করে মুক্তিপণ। আন্তর্জাতিক প্রতারকচক্রের ডেরা কখনো সাগর, কখনো থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ার সীমান্তের গহিন জঙ্গল। কয়েক বছর ধরে প্রতারকচক্র সক্রিয় হলেও ব্যাপকতা পায় এক দেড় বছর। ভয়ঙ্কর প্রতারকচক্রের অপকর্ম প্রকাশ পেয়েছে কয়েক মাস ধরে। ওদের ভয়ঙ্কর চেহারাও বেরিয়ে এসেছে। সাগরে বোট ও ছোট ছোট জাহাজে ভাসমান অবস্থায় ও মালয়েশিয়া থাইল্যান্ডের সীমান্তের গহিন জঙ্গল থেকে অসংখ্য নরকঙ্কাল ছাড়াও রুগ্ন মৃতপ্রায় মানুষকে উদ্ধারের মধ্যদিয়ে যে ছবি ফুটে উঠেছে তা রোমহর্ষকই নয়, মধ্যযুগীয় অসভ্যতাও। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন, প্রতারকচক্রের কবলে অতো মানুষ পড়লো কেন? শুধুই কি নিখরচায় বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর লোভ? নাকি কর্মসংস্থানের তীব্র সঙ্কটে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির আশা?

বেকারত্বের বোঝা যে সমাজে প্রায় অসহনীয় সেই সমাজের বেকারদের নিয়ে প্রতারণা করা কতোটা সহজ তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সঙ্ঘবদ্ধ অসংখ্য প্রতারকচক্র। চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের তিতুদহ ইউনিয়নের গবরগাড়া গ্রামের এক কিশোর কীভাবে প্রতারকচক্রের কবলে পড়ে। প্রতারকদের কবলে পড়ার পর কতোটা নির্যাতন করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ১৭ বছরের শফিকুল চুয়াডাঙ্গায় ফিরে রেডক্রিসেন্ট নেতৃবৃন্দের সামনে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে, গ্রামেরই এক ব্যক্তির নিকট থেকে কক্সবাজারের একজনের সেলফোন তথা মোবাইলফোনের নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করি। বাড়ি থেকে ২ হাজার টাকা নিয়ে রওনা হয়ে সেখানে পৌঁছেই বুঝি প্রতারকদের ডেরায় বন্দি হয়ে গেছি। সাগরে নেয়ার পর নির্যাতনের এক পর্যায়ে জানায়, বাড়িতে ফোন করে ৫০ হাজার টাকা দিতে বলো। টাকা দিলে দেশে ফিরিয়ে দেয়া হবে। অন্যথায় মেরে সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হবে।

মারতে হতো না, এমনিতেই মারা যেতো কিশোর শফিকুলসহ কৌশলে অপহরণ করা প্রতারকচক্রের ডেরায় বন্দি প্রায় তিনশ নারী-পুরুষ। মিয়ানমার নেভির পোশাকে অস্ট্রেলিয়ার নেভি তাদের উদ্ধার করে মিয়ানমারে পৌঁছে দেয়ায় বাড়ি ফিরতে পেরেছে তাদের মধ্যে ১৪৫ জন। এর মধ্যে শফিকুলসহ ৪ জনের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা। ইন্দোনেশিয়া থেকে ফেরত আনা ১১ জনের মধ্যেও চুয়াডাঙ্গার একজন রয়েছে। থাইল্যান্ডে উদ্ধার হওয়ার মধ্যেও চুয়াডাঙ্গার মানুষ রয়েছে। তবে ঠিক কতোজন তা নিশ্চিত করে জানা সম্ভব হয়নি। শুধু চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরের নয়, ঝিনাইদহসহ দেশের অধিকাংশ জেলারই মানুষ প্রতারিত হয়ে অপহরকচক্রের ডেরায় পড়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। হচ্ছে। প্রাণ হারিয়েছে, হারাচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হলো প্রতারক অপহরকচক্রের সদস্যরা সারাদেশেই ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। তারা কৌশলে প্রতারণার ফাঁদ ফেলেছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে ফাঁদে পড়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। প্রাণ হারিয়েছে কতোজন তার ইয়োত্তা নেই। অথচ গ্রামবাংলায় ছিটিয়ে ছড়িয়ে থাকা প্রতারক অপহরকচক্রের অসংখ্য সদস্যের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেয়ার নজির মিলছে না। হাতে গোনা কিছু গ্রেফতার হলেও অধিকাংশই যে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে তা বলাই বাহুল্য।

যেহেতু জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, শিগগিরই তেমনটি সম্ভব হবে বলেও আশা কম, সেহেতু জনশক্তিকে প্রবাসে কাজে লাগানোর তাগিদ দীর্ঘদিনের। নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, বিদেশে শ্রম বিক্রি করে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে শুধু চাঙ্গাই রাখেনি, রেমিটেন্স বাড়িয়ে চলেছে। অথচ জনশক্তি অপচয় রোধে গৃহীত কর্মসূচি সামান্য। মূলত সে কারণেই প্রতারক অপহরকচক্র ফাঁদ পাতার সুযোগ পেয়েছে। এ সুযোগ বন্ধ করতে হবে। প্রতারক অপহরকচক্রের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রবাসের পথকে করতে হবে নিরাপদ, সুগম। দেশে কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে প্রয়োজনে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারী শিল্প গড়ে তোলার বাস্তবমুখি পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে রাজধানী কেন্দ্রিক শিল্প গড়ে তোলার মানসিকতা দূর করে জেলা-উপজেলায় বিনিয়োগের পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি।

Leave a comment