স্টাফ রিপোর্টার: তীব্র গরমে জীবন দুর্বিষহ। দেশ জুড়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দিনে ও রাতের তাপমাত্রায় খুব একটা তফাত ঘটছে না। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। গত মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। এমনকি জুন মাসেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হবে বলে ধারণা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়ার বর্তমান এ অবস্থা বাংলাদেশের মানুষের জন্য, পরিবেশের জন্য গভীর সঙ্কটের কথাই বলছে। কোনটাই আমাদের জন্য সুখের খবর নয়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই আবহাওয়া বিগত কয়েক বছর ধরেই অস্বাভাবিক আচরণ করছে। গতকালও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ ৩৮ দশমিক৪ এ সর্বনিম্ন ২৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদফতর পরিবেশের এ অস্বাভাবিক আচরণের কারণে মানুষের জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে পড়েছে। গরমে দরদরিয়ে ঘাম ঝরে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। যারা রোদে ঘোরাফেরা করেন তীব্র রোদ আর অসহ্য ঘামের কারণে নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন। অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন মারাত্মক ডায়রিয়ায়। শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে ডায়রিয়া এবং জ্বরে। পানিশূন্যতা ও ঘাম থেকেই এ জর ও ডায়রিয়া হচ্ছে বলে জানান তারা। আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে, এ ভয়াবহ পরিস্থিতি খুব দ্রুত কাটবে না।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাচ্ছে, আগামী দুদিনের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম মরসুমী বায়ু বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে। এই মৌসুমী বায়ু মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে সপ্তাহখানেক থমকে ছিলো। টেকনাফ পর্যন্ত পৌঁছেছে পাঁচদিন আগে। কিন্তু যে গতিতে সারাদেশে বিস্তৃত হওয়ার কথা, তা হয়নি। ফলে দেশে অল্প-বিস্তর বৃষ্টিপাত হলেও তাপমাত্রা কমার ক্ষেত্রে তা খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পরে বৃষ্টিপাত বাড়লে তাপমাত্রা কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, দিনাজপুর ও সৈয়দপুর অঞ্চলসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
১৯৬০ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৩০ মে তাপমাত্রা নথিভুক্ত হয় ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাজশাহীতে। ১৯৯৫ সালে এসে নথিভুক্ত করা হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল নথিভুক্ত করা হয় বিগত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস যশোরে। এবছর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২২ মে ৩৯.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস চুয়াডাঙ্গায়। তাপমাত্রার এই পরিসংখ্যান আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে তাপমাত্রা কমছে কিন্তু বিস্তৃত, অতীতের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল কম, অথচ বর্তমানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্র অত্যধিক বেশি। কেননা, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের গবেষণায় দেখা যায়, শুধু ঢাকা শহরে মে মাসের গড় তাপমাত্রা ১৯৯৫ সালের ঐ মাসের তুলনায় বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশ। আর গত ১০০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা এমনকি ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে ১.২ সেলসিয়াস এবং ২১০০ সাল নাগাদ ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্যমতে, ২০১০ সাল ছিল বিগত ২৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বের উষ্ণতম বছর, আর ২০০১ থেকে ২০১০ সময়টুকু ছিল বিশ্বের উষ্ণতম কাল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক এসএম মাহমুদুল হক বলছেন, এ বছর স্বাভাবিকের তুলনায় বজ্রপাত বেশি হয়েছে। এখনই পরিপূর্ণ পরিসংখ্যান দেয়া না গেলেও স্বাভাবিক বজ্রপাত এবং ঝড়ের তুলনায় এবার অনেক বেশি হয়েছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলতে পারেন। তিনি জানান, সাধারণ হিসাবে এই তাপমাত্রা খুব বেশি না, বিগত কয়েক বছর ধরে এমন গরম পড়েই থাকে। তবে দীর্ঘ সময়ে তাপমাত্রা হিসাব করলে তাপপ্রবাহ স্থায়িত্বেও সময়টা বেড়েছে তুলনামূলকভাবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জলবায়ু বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আব্দুর রহমান বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই আবহাওয়ার এমন অস্বাভাবিক আচরণ। আর সারাবিশ্বের মানুষ জানে, ধনী দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের উপর। শুধু তাই নয়, এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত জরিপে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বিবেচিত।