স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে হলো দেশের মানুষের আত্মার বন্ধন

বাংলাদেশকে সাথে নিয়ে চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

 

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশকে সাথে নিয়ে চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত সুধী সমাবেশে তিনি বলেন, উন্নতির জন্য বাংলাদেশকে শুধু পাশে নয়, সাথে নিয়ে চলব। সমস্যা মোকাবেলায় একজোট হয়ে লড়ব। আজ আমরা একসাথে চলি, কাল একসাথে দৌড়াব। দু দিনের ঢাকা সফরের শেষ কর্মসূচিতে তিনি এসব কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সুধী সমাবেশে ভাষণ ছিলো তার এবারের দু দিনের সফলের সমাপনি কর্মসূচি। এরপর সরাসরি বিমানবন্দর থেকে ঢাকা ত্যাগ করেন রাষ্ট্রীয় এ অতিথি। ঢাকায় শেষ ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পাখি, বাতাস ও জলের কোনো ভিসা লাগে না। এজন্য জল কোনো রাজনীতির ভিত্তি নয়। এটি মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। তিস্তার সমাধানে আমাদের একজোট হয়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিশ্বাস ভেঙে গেলে চলবে না।

সীমান্ত হত্যার ব্যাপারেও হতাশা ব্যক্ত করেন এ নেতা। তিনি বলেন, সীমান্তে হত্যা একটি বেদনার বিষয়। সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির মতো কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়েও একজোট হয়ে কাজ করার আহবান জানান তিনি। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পৌঁছলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক তাকে স্বাগত জানান। বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। তারপর সুরেরধারা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তির পর স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মঞ্চে আসার সাথে সঙ্গে মুহুর্মুহু করতালিতে গোটা মিলনায়তন মুখর হয়ে ওঠে। মোদি বাংলায় বক্তৃতা শুরু করে বলেন, আমার বাংলাদেশের ভাই-বোনেরা নমস্কার। কেমন আছো? আমরা তোমার সাথে আছি। আমরা তোমাকে সাথে সাথে নিয়ে চলব। আমার বাংলা কেমন? এ সময় সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তারপর তিনি নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হিন্দিতে বক্তৃতা দেন। নরেন্দ্র মোদি তার বক্তৃতা শেষ করার সময় গোটা মিলনায়তনে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আবার আসবো। তখন আমার আড়ংয়ে যাওয়ার খুব ইচ্ছা আছে। নোয়াখালীতে গান্ধী আশ্রমে যাবো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িতে যাবো। পদ্মায় যুবকদের সাথে আড্ডা দেবো। আড্ডা ছাড়া বাংলাদেশে আসা অসম্পূর্ণ থাকবে। এ সময় তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে বাংলায় বলেন, আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়ির তীরে এই বাংলায়। তিনি বলেন, যে স্বপ্ন আমি আমার দেশের জন্য দেখি, একই স্বপ্ন আমি আপনাদের জন্যও দেখি। জয় বাংলা ও জয়হিন্দ বলে তিনি তার ভাষণ শেষ করেন।

মোদির বক্তৃতার পুরোটাজুড়েই ছিল বাংলাদেশের উন্নতির ভূয়সী প্রশংসা এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশা আর স্বপ্নের কথা। হিন্দিতে তার বক্তৃতা চলাকালে গোটা মিলনায়তনে ছিলো পিনপতন নীরবতা। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বক্তব্য শোনেন। তিনি মিলনায়তন ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সুধীজনের মাঝে মিশে যান এবং করমর্দন করেন। এ সময় দর্শকদের একাংশ আবেগাপ্লুত হয়ে ‘মোদি মোদি’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। নরেন্দ্র মোদি বলেন, এ দু দিনের সফরের পর শুধু এশিয়ায় নয়, গোটা বিশ্বে তার সফরের ফলাফল নিয়ে ময়নাতদন্ত করবে। কেউ মাপকাঠি নিয়ে খতিয়ে দেখবে কি দিলাম, কি পেলাম। আমি একবাক্যে বলবো, মানুষ মনে করে, আমি আপনাদের আশপাশে আছি, আমি বিশ্বকে বলবো, বাংলাদেশের শুধু পাশে নয়, একসাথেই আছি। মোদি তার জীবনের ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, বাংলাদেশের সাথে তার আবেগের সম্পর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশের সাথে ভারতের আবেগপূর্ণ যোগাযোগ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক জীবনে তার সাফল্যের কথা এবং বাংলাদেশ সফরকালে তার অভিজ্ঞতার বিষয়গুলোও তুলে ধরছেন বক্তৃতায়। নরেন্দ্র মোদি বলেন, নানা রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ বেশ কিছু ক্ষেত্রে দারুণ উন্নতি করেছে, যা উন্নয়নশীল দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমাকে অভিভূত করে। ভারত শুধু বাংলাদেশের আশপাশে নয়, তাদের সাথেও রয়েছে বলে জানান মোদি। তিনি বলেন, স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে আমরা দু দেশের মানুষের আত্মার বন্ধন ঘটিয়েছি। সুধী সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এদের মধ্যে রাজনৈতির দলের নেতা, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় নেতারাও উপস্থিত হয়েছিলেন। মোদি এ সময় তার ভাষায় ভারতপুত্র অটল বিহারি বাজপেয়িকে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় বিশেষ সম্মাননা দেয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মোদি বলেন, আমি এক মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতির হাত থেকে এ সম্মাননা গ্রহণ করেছি। আবার বঙ্গবন্ধু কন্যার উপস্থিতিতে সেই সম্মাননা নেয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, যৌবনে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম না। বাংলাদেশে লড়াইয়ের খবর পড়তাম। আপনাদের রক্ত যেমন গরম হয়ে যায়, ঠিক তেমনি আমার রক্তও গরম হতো। ওই সময়ে গ্রাম ছেড়ে বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য ভারতীয় সংঘের সাথে যুক্ত হলাম। এটাই ছিলো আমার প্রথম কোনো রাজনীতির কাজ। মোদি বাংলাদেশের উন্নতির প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশ উন্নতির যাত্রা শুরু করেছে। এখানে রাজনৈতিক সংঘাত এসেছে বারবার। বাংলাদেশে একের পর এক বাধাও এসেছে। এরপরও বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্দান্ত কাজ করেছে। বস্ত্রশিল্পে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। আমি চীনে গিয়েছিলাম। চীনে আমাকে একজন বলল, তোমরা সোয়াশ’ কোটির দেশ, কি করছ? আমি বললাম, কি হয়েছে? তিনি বলেন, তোমাদের পাশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্পে বিশ্বে দু নম্বর স্থানে রয়েছে। আমি মন থেকে বলছি, আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। প্রতিবেশীর এ দুর্দান্ত সাফল্য সত্যিই আমাকে অভিভূত করেছে।

নরেন্দ্র মোদি বলেন, সূর্য আগে এখানে ওঠে, তারপর আমাদের দেশে কিরণ যায়। মাতৃমৃত্যু রোধসহ সামাজিক অনেক কিছু বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশের অনেক রাজ্যকে শিখতে হবে। মোদি আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, বাংলাদেশে এসে গর্ববোধ করি এ কারণে যে, এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের সৈন্যরা রক্ত দিয়েছিলেন। এর চেয়ে গৌরবের আর কিছু হতে পারে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি লক্ষ্যই নির্ধারণ করেছেন আর তা হলো উন্নয়ন। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। এটি ছোট কোনো সাফল্য নয়। ভারত ও বাংলাদেশ একটি বিষয়ে সমতা অর্জন করেছে। সেটি হল ভারতে ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ৩৫ বছরের নিচে, বাংলাদেশেও ৬৫ শতাংশ মানুষ ৩৫ বছরের কম বয়সী। এ দু দেশ যুবশক্তিতে ভরা। যুবশক্তিই উন্নতির জন্য নেতৃত্বে রয়েছে। আজ সময় বদলেছে। বিশ্ব বদলেছে। আজ সাম্রাজ্যবাদের (বিস্তারবাদ) কোনো স্থান নেই। এখন প্রয়োজন উন্নতির।