বিদেশে শ্রম বিক্রির আকাঙ্ক্ষা এবং পাচারকারীদের অর্থলিপ্সতা

 

ভূমধ্য সাগরে ভাসমান অজস্র যুবকের মধ্যে শ শ বাংলাদেশি। কতোজনের মৃত্যু হয়েছে তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট না হলেও গত কদিন ধরে যে সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে তাও চমকে ওঠার মতো। খাদ্যাভাবে হাড্ডিসার মানুষের ছবি ও খাবার নিয়ে নৌকায় মারামারিতে শতাধিক মৃত্যুর সংবাদও ইন্দোনেশিয়া সরকারকে মানবিক করতে পারেনি। উল্টো সাগরে ভাসমানদের কোনো রকম সাহায্য না করার জন্য সেদেশের উপকূলীয় জেলেদের সতর্ক করে দিয়েছে। এদিকে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী গহীন জঙ্গলে মানবপাচারকারীদের অসংখ্য বন্দিশিবিরের সন্ধান মিলেছে। গণকবরের পাশাপাশি অসংখ্য প্রবাসগামীদের মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যেও রয়েছে অসংখ্য বাংলাদেশি। এসব খবরে গ্রামবাংলায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মায়ের অশ্রু ঝরছে দিন-রাত। স্ত্রী কেঁদে ভাসাচ্ছে বালিশ। বোনের কান্না থামছে না কিছুতেই। পিতা হয়ে পড়েছে হতভম্ব। ভাই খুঁজছে ভাইকে ফেরানোর উপায়।

বিদেশে মোটা অঙ্কের বেতনে ভালো চাকরির প্রলোভনে গ্রামবাংলার অসংখ্য যুবককে যারা আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের হাতে তুলে দিয়েছে তারা এলাকারই অর্থলিপ্সু। এদেরকে আঞ্চলিকভাবে ‘মানবপাচারকারীদের দালাল’ বলে আখ্যা দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠতে শুরু করেছে। গতকাল দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে শুধু আলমডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের কিছু এলাকার গুটিকয়েক প্রতারিত পরিবারের খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতেই স্পষ্ট, ভূমধ্যসাগরে ও থাইল্যান্ডের গহীন জঙ্গলে যারা নির্মম নির্যাতনের শিকার, দিনের পর দিন খাবার না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে যারা, তারা কারা। দেশে চাহিদা মতো কর্মসংস্থান নেই। দারিদ্র্য। এ সুযোগে অল্প খরচে পানিপথে বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখিয়ে পাচারকারীরা আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের হাতে যারা এলাকার অসংখ্য যুবককে তুলে দিয়েছে তাদের অধিকাংশই গাঢাকা দিয়েছে বলে অভিযোগ।

‘এখন যতোটুকু পারো ততোটুকু টাকাই দাও, পরে বিদেশে চাকরি করে বাকি টাকা পরিশোধ করো’ এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিনাপাসপোর্টেই অধিকাংশকে নেয়া হয়েছে দেশের কক্সবাজার, টেকনাফে। তোলা হয়েছে সাগরপাড়ি দেয়ার মতো নৌকায়। ১০ জনকে বহন করা ক্ষমতার নৌকায় তোলা হয়েছে শ শ যুবক। সাগরে ভাসার পর পাচারের শিকার হচ্ছে জানার পর কেউ উচ্চবাচ্য করলেই তাকে সাগরে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে আসা যুবকের মুখ থেকেও এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কারা পাচারকারী, কেন পাচারের শিকার হচ্ছে গ্রামের অসংখ্য যুবক? এসব প্রশ্নের জবাব বোধকরি সরকারের দায়িত্বশীলদের অজানা নয়। দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান যেমন নেই, তেমনই বিদেশে শ্রম বিক্রিতে আগ্রহীদের চাহিদা মতো সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়ায় গমনেচ্ছুদের রেজিস্ট্রেশন করা হয়। তাতে যে ভিড় লক্ষ্য করা যায়, তা দেখে কারোরই বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, দেশের যুবসমাজ কী অবস্থায় আছে।

নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে প্রবাসে বিকোনো শ্রমের অর্থ। কে কীভাবে প্রবাসে পাড়ি জমিয়ে শ্রম বিক্রি করে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছে সে হিসেব ক’জন রাখে? যেহেতু দেশে বেকার সমস্যা প্রকট, কর্মসংস্থানের তীব্র সঙ্কটের কারণে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর স্বপ্নে বিভোর বেকার যুবকদের সামনে যখনই পাচারকারীরা স্বল্প খরচে বিদেশে পাঠানোর টোপ ফেলছে, তখনই আগ-পেছ না ভেবে ওদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে যুবসমাজ। এরাই পাচারের পর বন্দি হচ্ছে। মুক্তিপণের নামে টাকা আদায় করছে সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী জঙ্গল থেকে উদ্ধারকৃতদের মুখ থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আর ভূমধ্যসাগরে? মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অমানবিকভাবে ইউরোপের কিছু দেশে পৌঁছে দেয়ার নামে প্রতারণা করছে পাচারকারী চক্র।

বিদেশে পাঠানোর নামে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, সাগরে ফেলে হত্যা সম্পর্কে গ্রামবাংলায় শুধু সচেতনতার আলো ছড়ালেই হবে না, বিদেশে সুহালে পৌঁছুনো এবং নিরাপদে শ্রম বিক্রির বাজার গড়ে তুলতে হবে। একই সাথে দেশেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান গড়ে তোলা জরুরি। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে দেশে বড় বড় ভারী শিল্প যেমন গড়ে তোলা সম্ভব, তেমনই দেশের বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও শিল্প গড়ে তোলার বাস্তবমুখি পদক্ষেপ দরকার। মানবপাচারকারীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দালালের খপ্পরে পড়ে ছেলে হারিয়ে অসহায় পরিবার শোকে কাতর। তারা কখন অভিযোগ করবে কখন পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে সে অপেক্ষায়, ওই ধরনের অপরাধীরা পালানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। ফলে আর নয় কালবিলম্ব। এখনই পদক্ষেপ নেয়ার উপযুক্ত সময়। উদাসীনতা অপরাধীদের উৎসাহিত করে।

পুনশ্চ: ওরা চুরি করতে নয় শ্রম বিকিয়ে ভাগ্য ঘোরানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রতারণার শিকার।