প্রধানমন্ত্রী কাঁদলেন, সবাইকে কাঁদালেন : ঘাত-প্রতিঘাতেও দিশা হারাইনি

স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর পর দেশে ফেরার দিনটিতে জনগণের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগে ইচ্ছা ঝরলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় দলীয় নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা উত্তরে সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে কখনো কেঁপে উঠেছে তার কণ্ঠ, কখনো দেখা গেছে মুছতে সজল চোখ। দিবসটি চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহসহ সারাদেশেই পালন করেছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহ।

শুভেচ্ছার সশয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব হারিয়ে আমার শুধু দেয়ার পালা। মানুষের জন্য করে যাচ্ছি। দেশের মানুষের জন্য যে ত্যাগ করার করবো, আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’ গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতারা তাকে শুভেচ্ছা জানান। প্রথমে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা শেখ হাসিনাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এ সময় জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। গণভবনের ব্যাঙ্কোয়েট হলে উপস্থিত নেতারা এ সময় ‘জয় বাংলা’, ‘শেখ হাসিনার জন্য বাংলাদেশ ধন্য’ স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই দেশ ছেড়ে জার্মানি যাওয়া থেকে শুরু করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসার বিভিন্ন টুকরো স্মৃতি তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা শুরুতেই বলেন, ‘৩৪ বছর আগে ঝড়ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর বিদেশে অবস্থান করে ফিরে এসেছিলাম।’

ছয় বছর দেশে ফিরতে না দেয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশে ফিরতে দেয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে থাকতে হয়েছিলো।’ ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই ছোট বোন শেখ রেহানা এবং ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুলকে নিয়ে জার্মানিতে স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থলের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ১৫ আগস্টের পরের ঘটনা স্মরণ করে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কখনো শুনেছি, মা বেঁচে আছে। কখনো শুনেছি, রাসেল বেঁচে আছে।’ কয়েক মুহূর্ত থেমে থেকে ফের বলতে শুরু করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। ‘মানুষ একটা শোক সইতে পারে না। আমরা পরিবারের সকল সদস্যকে হারিয়েছি।’
১৫ আগস্টের পর পশ্চিম জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোথায় যাব কিছুই জানি না। হুমায়ুন রশীদ তার বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। দেশে ফেরার তখন প্রবল আগ্রহ। দিল্লিতে আসলাম। শুনলাম, কেউ নেই। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে সব হারাই।’ দেশে আসতে দেবে না। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিলাম। ছয় বছর সেখানেই ছিলাম। দিল্লি থেকে ১৯৭৭ সালে শেখ রেহানা লন্ডনে চলে যান।  শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমি যেন আসতে না পারি, সেজন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিলো।’ ১৭ মে’র কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পুতুলকে নিয়ে ফিরলাম। জয়কে রেহানা লন্ডনে নিয়ে গেলো। এয়ারপোর্টে নামলাম। মাটিতে লাখো মানুষের ঢল। চারদিকে লাখো মানুষ। এই হাজার মানুষের ভিড়ে আমি খুঁজছিলাম…।’

এই কথাগুলো বলে কেঁদে ফেলেন শেখ হাসিনা। পুরো ব্যাঙ্কোয়েট হলে তখন পিনপতন নিস্তব্ধতা। শেখ হাসিনা আবার বলতে শুরু করলেন। ‘মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হলাম। কিন্তু যে ভালোবাসার মানুষকে রেখে গিয়েছিলাম, তাদের পাই নাই।’ ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই দুই বোন এবং জয় ও পুতুলকে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন, শেখ কামাল, সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল এবং শেখ রাসেল। তিনি বলেন, ‘কিন্তু যেদিন ফিরে আসলাম, কাউকে পেলাম না। এতো, মানুষের ভালোবাসায়, এতো রিক্ত, এতো অসহায় আমি।’ বক্তব্যের এ পর্যায়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। নেতাকর্মীদের অনেকের চোখ ততোক্ষণে ভিজে গেছে। কাউকে কাউকে দেখা গেলো চোখ মুছছেন। ‘সহ্য হয়নি। বনানীর সারি সারি কবর।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক ও দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব হারিয়েছি ঠিকই। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি।’ এতো মানুষ মাথায় হাত বুলিয়েছে। মনে হয় বাবার আদর, মা’র ভালোবাসা পাচ্ছি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। দিশা হারাই নাই। আব্বা-আম্মার কথা মনে রেখেছি। অনেক স্মৃতি, অনেক কথা মনে পড়ে। সব বলাও কঠিন, বলতেও পারি না।’ তিনি বলেন, ‘সংগঠন আমার পাশে, বাংলার জনগণ আমার পাশে, তাদের দোয়া-আশীর্বাদ, এটাই আমার শক্তি।’ তিনি বলেন, ‘কেউ ভাবতে পারেনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ মাথা উঁচু করবে। আমরা আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছি।’

‘ভবিষ্যতে যেনো বাংলাদেশ অন্ধকার যুগে না যায়, সেজন্য সজাগ থাকতে হবে।’

এদিকে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলের মালা দেন এবং পতাকা তোলেন নেতৃবৃন্দ। এ সময় জেলার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে ঝিনাইদহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩৪ তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ঝিনাইদহে ৱ্যালি ও সমাবেশ করেছে ছাত্রলীগ। গতকাল সকালে ঝিনাইদহ সরকারি কেসি কলেজ থেকে এক বর্ণাঢ্য ৱ্যালি বের হয়। ৱ্যালিটি শহর ঘুরে কেসি কলেজ শহীদ মিনার চত্বরে ফিরে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়। সমাবেশে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাকিল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক রানা হামিদসহ নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন।