কৃষকদের পাওনা ২০ কোটি টাকা
শিপলু জামান: চিনিকলে আখ দেয়ার তিন দিনের মধ্যে কৃষকদের পাওনা পরিশোধের নিয়ম থাকলেও চলতি মরসুমের গত আড়াই মাসে একটি টাকাও পরিশোধ করেনি ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ চিনিকল কর্তৃপক্ষ (মোচিক)। মিলজোন এলাকায় ১০ হাজার কৃষক তাদের আখের ২০ কোটি টাকা পাবে মিল কর্তৃপক্ষের কাছে। আখ বিক্রির টাকা না পাওয়ায় কৃষকেরা ব্যাংক, এনজিও, দোকানপাটের দেনা পরিশোধ করতে পারছেন না। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারছেন না ১০ হাজার কৃষক। তাদের সংসারে নেমে এসেছে চরম অর্থাভাব। পাওনা টাকা না পেয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন ১০ হাজার কৃষক পরিবারের ৪০ হাজার মানুষ। নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আখ চাষ ছাড়ছেন কৃষকরা। ভেঙে দিচ্ছেন রোপণকৃত আখও।
পাওনা টাকার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন কৃষকেরা। করেছেন সংবাদ সম্মেলন। এলাকায় বিক্ষোভ আর মানববন্ধনের ডাক দিলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তা থামিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা। এদিকে মিলের শ্রমিক-কর্মচারীদের দু মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়েছে। অন্যদিকে চিনিকল কর্তৃপক্ষ বলছে, চিনি বিক্রি না হওয়ায় এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকল ১৯৬৫ সালে স্থাপিত হয় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে। ১৯৬৭-৬৮ মাড়াই মরসুম থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিনিকলটি তাদের উৎপাদন শুরু করে। মোচিক রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৯৮৩-৮৪ মাড়াই মরসুমের পর থেকেই লোকসানে পড়ে চিনিকলটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোট ৪৫টি মাড়াই মরসুমে মাত্র ১৬ বার লাভের মুখ দেখলেও বাকি মরসুমগুলোতে লোকসান গুনতে হয়েছে শত কোটি টাকা। গত মরসুমে ১২০ কার্যদিবসে ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১৩ ডিসেম্বর আখ মাড়াই মরসুম উদ্বোধন করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। সে সময় মিল এলাকায় ৮ হাজার ৫ একর জমিতে আখ থাকলেও এ বছর কৃষকরা মাত্র ৬ হাজার ৬০০ একর জমিতে আখ চাষ করছে। চলতি ২০১৩-১৪ মরসুমে এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৯১৮ মেট্রিক টন উৎপাদিত চিনিসহ মোট ১৭ হাজার ৩৪৬ মেট্রিক টন অবিক্রিত অবস্থায় রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ৭০ কোটি টাকা। গত ২০১২-১৩ মরসুমের চিনি রয়েছে ৭ হাজার ৪৫ মেট্রিক টন। ২০১১-১২ মরসুমের উৎপাদিত চিনি রয়েছে ৩৮২ মেট্রিক টন। এসব চিনি গোডাউনে নষ্ট হচ্ছে।
এদিকে হতাশা আর ক্ষোভ কৃষক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দের মাঝেও। চিনিকল কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালি ব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতিকে দায়ী করছেন তারা। মোচিক আখ চাষী শরিফুল ইসলাম বলেন, সে কালের নীল চাষের শোষণের সাথে মিলে গেছে বর্তমানের আখ চাষ। তিনি জানান, কৃষকেরা মাঠের পর মাঠ তাদের রোপণকৃত আখ ভেঙে সেখানে অন্য ফসলের চাষ করছেন। এর জন্য দায়ী চিনিকল কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনা।
মোচিক শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমান জানান, শ্রমিকদের দু আড়াই মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। মিলজোন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মানবেতর দিন কাটছে ১০ হাজার কৃষক পরিবারের ৪০ হাজার মানুষের। কৃষক ইমদাদুল হক জানান, হাজার হাজার কৃষক তাদের সংসার চালাতে পারছেন না অর্থাভাবে। আখ চাষে সার ওষুধ, ডিজেলসহ উপকরণের দাম বাড়লেও বাড়ছে না আখের দাম। মণপ্রতি দাম মাত্র ১০০ টাকা। গত তিন বছরে এ দাম বাড়ানো হয়নি। এক বছরের অর্থাৎ বার্ষিক ফসল আখ উৎপাদন করে মিলের কাছে বিক্রি করে চাষিরা। চলতি মাড়াই মরসুম শেষ হতে চললেও কৃষকদের দেয়া হয়নি কোনো টাকা। পাওনা ২০ কোটি টাকার দাবিতে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন করেছিলেন প্রান্তিক আখ চাষিরা।
কৃষকরা সময়মতো আখের দাম না পাওয়ায় কমছে আখচাষ। একই সাথে কৃষকরা রোপণকৃত আখ ভেঙে দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন প্রতিবেদককে বলেন, বাজার মূল্যের সাথে পার্থক্য থাকায় চিনি বিক্রি হচ্ছে না।