থাইল্যান্ডে ৯১ বাংলাদেশিসহ ১১৭ অভিবাসী উদ্ধার

মাথাভাঙ্গা মনিটর: থাইল্যান্ডের শঙ্খলা প্রদেশের রাত্তাফুম থেকে ১১৭ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৯১ জন বাংলাদেশি ও বাকিরা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান। থাইল্যান্ড সীমান্ত ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় এসব অভিবাসীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এদিকে থাইল্যান্ডের সামরিক জান্তা প্রধান প্রায়ুথ চ্যান ওচা মানবপাচার বন্ধে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।

থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত থেকে উদ্ধার ১১৭ জনই পাচারের শিকার কি-না- সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে শনিবার শতাধিক অভিবাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে থাই প্রশাসন। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন প্রায়ুথ চ্যান ওচা।

এ পর্যন্ত সীমান্তের জঙ্গল থেকে ৩৩টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব মৃতদেহ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম অভিবাসীদের বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত সপ্তাহে শংখলার প্রদেশে জঙ্গলে মাটিচাপা দেয়া অবস্থায় মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়।

এছাড়া সন্ধান পাওয়া গেছে তিনটি এলাকার যেগুলো পাচারকারীরা লুকানোর জন্য ব্যবহার করতো বলে ধারণা করা হচ্ছে। মালয়েশীয় সীমান্তবর্তী শংখলা প্রদেশের রাত্তাফুম জেলা থেকে উদ্ধার করা ১১৭ জনের মধ্যে ২৬ জনই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম এবং বাকিরা বাংলাদেশি বলে জানিয়েছেন প্রাদেশিক উপ-গভর্নর ইকারাত সিসেন।

উদ্ধারকৃতরা পাচারের শিকার হয়ে থাকলে তাদের দেশটির সামাজিক উন্নয়ন ও জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলেও জানান তিনি। তাদের অভিবাসনবিষয়ক আইনি সংস্থার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এর আগে শুক্রবার ১১১ অভিবাসীর সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছিল পুলিশ।

রাত্তাফুম জেলার একটি প্রশাসনিক সম্মেলনকক্ষে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে ১১৭ অভিবাসীকে। তাদের মধ্যে তিনজন শিশুও রয়েছে। ওই কক্ষেই তারা দাঁত মাজছেন, ঘুমাচ্ছেন, নামাজ পড়ছেন, খাচ্ছেন এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। কয়েকজন স্থানীয় গ্রামবাসী উদ্ধারকৃতদের জন্য পানি, চাল ও ফল দান করে গেছেন।

বাংলাদেশের নাগরিক ১৩ বছরের কিশোর বুশরি সালাম জানিয়েছে, একটি দলের সঙ্গে একই নৌকায় চড়ে সে থাইল্যান্ডে এসে পৌঁছেছিলো। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর চেষ্টায় প্রায় ২ সপ্তাহ তারা থাই জঙ্গলে আটকে ছিলো। বুশরি জানায়, আমার ভাই মালয়েশিয়া থাকে। আমিও সেখানে যেতে চাই।

আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান ওচার: যেসব দেশ থেকে অবৈধপথে অভিবাসীরা আসেন সেসব দেশই নয়, যেসব দেশে এসব অভিবাসীরা যান তাদেরও মানবপাচার বন্ধের ক্ষেত্রে যথেষ্ট করণীয় আছে বলে মনে করেন থাইল্যান্ডের জান্তা প্রধান প্রায়ুথ চ্যান ওচা। সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে ত্রিদেশীয় বৈঠক আহ্বান করেছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে ওচা বলেন, দু প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারের সাথে বৈঠকের ব্যাপারে আলোচনা করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ওচা জানান, চলতি মাসের শেষ নাগাদ এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে। একই সাথে সঙ্কট সমাধানে একটি বহুপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলনেরও ডাক দিয়েছেন ওচা।

বৈঠকের ব্যাপারে নিশ্চিত করেনি মালয়েশিয়া আর মিয়ানমার। তবে সম্মেলনে যোগ দিতে আগ্রহী অস্ট্রেলিয়া। মিয়ানমারের অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব মিন্ট কেয়িং বলেন, এখনও থাইল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে বৈঠকের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। মিয়ানমারের মানব পাচারবিরোধী পুলিশ বাহিনীর প্রধান উইন নাইং তুন জানান, থাই সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করা হলে আমরা বৈঠকের ব্যাপারে আগ্রহী হব বলে আমি আশা করি। তবে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এদিকে থাইল্যান্ডে বহুপাক্ষিক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে তাতে যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে অস্ট্রেলিয়া। প্রায়ুথ চ্যান ওচার সঙ্গে বৈঠকের পর অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলিয়া বিশপ এ কথা জানান। কোনো দেশের একার পক্ষে মানব পাচার ঠেকানো সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০২ সালের বালি প্রসেস অনুযায়ী, মানবপাচার ও অভিবাসীদের অবৈধ আনাগোনা বন্ধে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, মালয়েশিয়াসহ ৪৫টি দেশের একসঙ্গে কাজ করার কথা। মানব পাচার বন্ধে তাই আঞ্চলিক উদ্যোগ আহ্বান করেছেন তিনি।

থাই কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করলেন ওচা: শুক্রবার রাতে টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে মানবপাচারের ঘটনায় থাই সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন ওচা। তিনি জানান, মানব পাচারের ঘটনায় এরই মধ্যে একজন মেয়র, একজন ডেপুটি মেয়রকে গ্রেফতার এবং ৫০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এর আগে থাইল্যান্ডের ডেপুটি ন্যাশনাল পুলিশের প্রধান জানান, মানবপাচারের ঘটনার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত পেদাং বাসারের মেয়র বাংজোং পংপল আত্মসমর্পণ করেছেন। নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোও অস্বীকার করেছেন বাংজোং।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের পরিসংখ্যান বলে, চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসেই পাচারকারীদের নৌকায় চড়ে থাইল্যান্ডে পৌঁছেছে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশী এবং রোহিঙ্গা মুসলিম। গত বছর এই সময় এ সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধেক। শুক্রবার এই তথ্য প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। মূলত ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দারিদ্র্য থেকে বঁাঁচতেই এই দুর্গম পথে ভিন দেশে যাওয়ার চেষ্টা এ অভিবাসীদের।

টেকনাফে পাচারকারীরা গা-ঢাকা দিচ্ছে: থাইল্যান্ডে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়া ও ক্রসফায়ারে ৩ শীর্ষ মানবপাচারকারী নিহতের পর টেকনাফের চিহ্নিত মানবপাচারকারীরা গা-ঢাকা দিতে শুরু করেছে। অপরদিকে মানবপাচার বন্ধে এবার টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে অস্থায়ী ৱ্যাবক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

ৱ্যাব-৭ এর একটি টিম শনিবার মানব পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে পরিচিত টেকনাফের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও নাফনদী বেষ্টিত শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় অবস্থান নেয়। জানা গেছে, প্রায় ৩০ সদস্যের ৱ্যাব টিম সকালে শাহপরীর দ্বীপ উচ্চ বিদ্যালয়ে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে চিহ্নিত মানবপাচারকারীরা গা-ঢাকা দিতে শুরু করেছে।