মাথাভাঙ্গা মনিটর: ব্রিটেনে বৃহস্পতিবার সাধারণ নির্বাচন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ কয়েকটি কাউন্সিলে নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকে বিরতিহীনভাবে সারা দেশে ভোট গ্রহণ করা হয়। সকালে কাজে যাওয়ার সময় অনেকে নিজেদের ভোট প্রদান করেছেন। অধিকাংশ ভোটার নিজেদের ভোট প্রদান করেছেন কর্মক্ষেত্র থেকে বাসায় ফেরার সময়। তাই বিকাল ৫টার পর ভোট কেন্দ্রগুলোতে সকালের তুলনায় ভিড় বেশি ছিল। আজ লন্ডন সময় দুপুর ১টার (সন্ধ্যা ৭টা) মধ্যে চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। বিভিন্ন জরিপে কোয়ালিশন সরকারের আশংকার কথা বলা হয়েছে। সারা দেশে ৫০ হাজার ভোট কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। স্কুল, স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারগুলোতেই ছিল বেশির ভাগ ভোট কেন্দ্র। ৫০ মিলিয়ন ভোটার এ বছর রেজিস্ট্রেশন করেছে। ৯ হাজার স্থানীয় সংস্থার মেয়াদ উত্তীর্ণ আসনে ভোট গ্রহণ হয়েছে। ২৭৯টি সিটি কাউন্সিলে এসব আসন খালি ছিল। প্রতিটি পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় কিছু কাউন্সিলের আসনেও নির্বাচন হয়। বেশ কয়েকটি সিটিতে সরাসরি মেয়র নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হয়েছে। ব্রাডফোর্ড, মিডিলবারা, মেনসফিল্ড, লিস্টার, কপল্যান্ড, আগে এসব শহরে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ সমর্থনে মেয়র নির্বাচিত হতো। এবার থেকে জনগণের সরাসরি ভোটে এসব শহরে মেয়র নির্বাচিত হচ্ছেন। প্রচলিত মেয়র নির্বাচনের প্রথা থেকে সরে এসে জনগণের সরাসরি ভোটে মেয়র নির্বাচন পদ্ধতি বেশ কয়েক বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে চালু করা হয়েছে। এতে জনগণের সম্পৃক্ততা মেয়রের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাওয়ার এ পদ্ধতিটি ব্রিটেনের সবগুলো কাউন্সিলে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এবারের নির্বাচনে এথনিক মাইনোরিটির ভোটাররা একটি বড় ফ্যাক্টর। যে দল তাদের সুযোগ-সুবিধা বেশি নিশ্চিত করতে পারবেন তারাই এথনিক ভোট বেশি টানতে পারবেন। ইমিগ্রেশন সমস্যা নিয়ে বড় তিনটি রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের আগে আকর্ষণীয় কথা বলেছেন। তবে কনজারভেটিভ পার্টির তুলনায় ইমিগ্রেন্টরা লেবার পার্টিকে তাদের বেশি আপন বলে মনে করেন।
বিগত কনজারভেটিভ পার্টি ব্রিটেনের অর্থনীতিকে দেউলিয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ওয়েলফেয়ার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি খাতে ব্যাপক সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিয়েছিল, এতে ব্রিটেনের অর্থনীতি রক্ষা পেলেও ওয়েলফেয়ার বাজেট কাটছাঁট করায় দারিদ্র্যপীড়িত এবং স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। টোরি পার্টি এসব ক্ষেত্রে বাজেট কাটছাঁট করে। স্বল্প আয়ের মানুষ তা ভালো চোখে দেখেনি। তাই ভোট প্রদানের এই সুযোগে টোরিদের ওপর তারা প্রতিশোধ নিতে পারেন। অপরদিকে ব্রিটেনের মুসলমান অধিবাসীরা ভোটের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অবদান রাখেন। সব দলই মুসলমানদের পক্ষে নিতে বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কোনো দল তাদের কি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল সে বিষয় বিবেচনা করে তারা ভোট প্রদান করবেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সারা দেশের বাঙালি ভোটাররা তাদের নিজ নিজ টাউনের ২২টি আসনের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন। তাদের ভোটে ওইসব আসনে এমপিরা বিজয়ী হয়ে থাকে।
বাঙালি ভোটাররা পুরো ৬ সপ্তাহ নিজ নিজ এলাকার এমপিদের জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। শ্বেতাঙ্গ এমপি প্রার্থীদের ৮৯% ভাগই বাঙালিদের কোনো না কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়মিত ‘ভাত-তরকারি’ খেতে আসেন। বাঙালিরা সব দলের পক্ষেই নিজেদের পছন্দ মতো প্রচারণা চালিয়েছেন।
এদিকে বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেট এলাকায় লেবার পার্টি এমপি প্রার্থী রুশনারা আলীর পক্ষে বিপুলসংখ্যক ভোটার ভোট প্রদানে টাওয়ার হ্যামলেটের সেন্টারগুলোতে জড়ো হন। এ আসনে তিনি এগিয়ে রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। হ্যামস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষে বাঙালিরা ব্যাপকভারে ভোট প্রদান করেছেন। সেখানে ৪২ ভোটের ব্যবধানে বিগত পার্লামেন্ট নির্বাচনে লেবার পার্টির এমপি জয়ী হয়েছিলেন। বাঙালিদের অংশগ্রহণ এবং তার ব্যাপক প্রচারণা আসনটিতে টিউলিপের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়ে দিয়েছে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রত্যেক প্রার্থী ৫০০ পাউন্ড জামানত হিসেবে প্রদান করেছেন কাস্ট হওয়া ভোটের ৫%-এর কম পেলে তা ফেরত পাবেন না।
নির্বাচনে সবগুলো জনমত জরিপে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের অর্থাৎ কনজারভেটিভ পার্টি এবং লেবার পার্টি কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিটি জরিপে কনজারভেটিভ কখনো এগিয়ে, কখনো লেবার পার্টি এগিয়ে ছিল বলে দেখানো হয়েছে। সবশেষ জরিপে দ্য গার্ডিয়ান পুলে কনজারভেটিভ ৩৪%, লেবার পার্টি ৩৩% ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল পার্লামেন্টের ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৩২৬টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে একক সরকার গঠন প্রক্রিয়ার জটিলতা দেখে দেবে। এক্ষেত্রে ছোট কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে।
সমঝোতার জন্য বড় দলগুলোকে সর্বোচ্চ দু’সপ্তাহ সময় দেয়া হবে। এরপর যে দল বেশি এমপিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবে তাদের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানাবেন। এর আগে মেজরিটি এমপি তাদের পক্ষে আছেন তা দেখাতে হবে। কনজারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে আবারও হয়তো গতবারের মতো তাদের কোয়ালিশন অংশীদারি লিবারেল ডেমোক্রেটদের সঙ্গে জোট করতে হতে পারে। লেবার পার্টিও ছোট শরিক দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী পক্ষের দল এসএমপি দলের সঙ্গে লেবার পার্টি কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে না বলে আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। তবে সবকিছু ফল জানতে শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ব্রিটেনের জনগণকে।
দৃষ্টি তিন কন্যার দিকে: যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচনে এমপি পদের জন্য লেবার দলের হয়ে লড়ছেন তিন বাংলাদেশী কন্যা রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক ও রূপা আশা হক। লর্ড অ্যাশক্রফট পরিচালিত আসনভিত্তিক জরিপে তিনজনই ভোটের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। গতবারের নির্বাচনে (২০১০ সাল) জয়ী হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি হন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রুশনারা আলী। তার বিজয়ের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশীদের অভিষেক ঘটে। জরিপের ফলে রুশনারার পাশাপাশি এবার এগিয়ে রয়েছেন টিউলিপ ও রূপা। সাম্প্রতিক এই জরিপের পর্যালোচনা করে ‘লর্ড অ্যাশক্রফট পোলস’ বলছে আগের ফলাফলের তেমন একটা বদল হয়নি। রুশনারা সিলেটি কন্যা। জন্ম বিশ্বনাথে। গতবার পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে প্রায় ১২ হাজার ভোট বেশি পেয়ে তিনি বিজয়ী হন। এবারও একই আসনে লড়ছেন তিনি। এবার বড় ব্যবধানে জেতার সম্ভাবনা রয়েছে তার।
আসনভিত্তিক জরিপে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে টিউলিপ এবং লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনে রূপা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে বেশি ব্যবধানে এগিয়ে আছেন।
লন্ডনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ১০টি আসনের শীর্ষে রয়েছে হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন। আসনটিতে ২৩ বছর ধরে টানা এমপি ছিলেন লেবার দলের অস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী গ্লেন্ডা জ্যাকসন। ২০১০ সালের নির্বাচনে মাত্র ৪২ ভোটের ব্যবধানে তিনি জিতেছিলেন। ওই নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোটের ব্যবধানে ফল নির্ধারণের আসন ছিল এটি। এ কারণে এবার আসনটি পেতে মরিয়া কনজারভেটিভ দল। আসনটিতে দখল রাখতে চান লেবার দলের নতুন প্রার্থী টিউলিপ। টিউলিপ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে। জরিপে টিউলিপ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কনজারভেটিভ দলের সায়মন মার্কাসের চেয়ে ১৭ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।
লন্ডনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসন ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকট। এ আসনে গতবার তিন হাজার ৭১৬ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন কনজারভেটিভ-দলীয় প্রার্থী এঞ্জি ব্রে। ২০১০ সালের নির্বাচনে এঞ্জি ব্রে পেয়েছিলেন ১৭ হাজার ৯৪৪ ভোট। ১৪ হাজার ২২৮ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন লেবার দলের প্রার্থী। এবার এঞ্জি ব্রের সঙ্গে লেবার দলের হয়ে লড়ছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত রূপা হক। লর্ড অ্যাশক্রফটের জরিপে এ আসনে রূপা হক ৬ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। রূপা কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আদি বাড়ি পাবনায়। এবার যুক্তরাজ্যের প্রধান তিনটি দল থেকে মোট ১১ জন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রার্থী এমপি পদে লড়ছেন। তাদের মধ্যে লেবার দল থেকে সাতজন, লিবারেল ডেমোক্র্যাট দল থেকে তিনজন এবং কনজারভেটিভ দল থেকে একজন মনোনয়ন পেয়েছেন।
নির্বাচনে ভোট দেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা: ব্রিটিশদের পাশাপাশি সাধারণ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরাও। সকাল থেকেই লন্ডন ও আশপাশের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজন। তাদের আশা ক্ষমতায় যেই আসুক, প্রবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নতুন সরকারের কাছে গুরুত্ব পাবে।