প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১৩ হাজার পদ : দপ্তরি নিয়োগও এমপিদের হাতে

হঠাৎ করে নীতি মালা সংশোধন কোনো রক পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ : তিনজনের মধ্য থেকে নিয়োগ চূড়ান্ত করবেন এমপি : অনিয়মের প্রশ্ন তোলা যাবে না

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রায় ১৩ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দপ্তরি কাম প্রহরী পদে লোক নিয়োগের ক্ষমতা পেয়েছেন এবার সংসদ সদস্যরা (এমপি)। দেশের প্রায় ৩৭ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম প্রহরী নিয়োগের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ অর্থাৎ তৃতীয় ধাপে এসে নীতিমালা সংশোধন করে এমপিদের এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আগের দু ধাপের নিয়োগে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হলেও এবার তা বাদ দেয়া হয়েছে। একইভাবে আগের দু ধাপে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম হলে অভিযোগ করার সুযোগ রাখা হলেও এবার সেই সুযোগও রাখা হয়নি। আগামী জুন মাসের মধ্যে এ নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা। আগের দু ধাপের নিয়োগের ক্ষেত্রে সারা দেশেই ব্যাপক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। আর নতুন নীতিমালার আলোকে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বাড়ার সাথে সাথে দলীয়করণের অভিযোগও যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের ৩৬ হাজার ৯৮৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে দপ্তরি-কাম প্রহরী নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে। প্রথম বছর নিয়োগ দেওয়া হয় ১২ হাজার। এরপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নিয়োগ দেয়া হয় আরো ১২ হাজার। এ বছর নিয়োগ দেয়ার কথা ১২ হাজার ৯৮৮ জন।

আগের দু বছরের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় বাছাই ও নিয়োগ কমিটি ছিল তিন সদস্যের। সভাপতি ছিলেন বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির (এসএমসি) সভাপতি। সদস্য ছিলেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ওই নিয়োগপ্রক্রিয়া ছিল স্থানীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়কেন্দ্রিক। চলতি বছরের নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই সংশোধন করা হয়েছে এই নিয়োগ নীতিমালা। ২৬ জানুয়ারি সংশোধিত নীতিমালার গেজেট প্রকাশিত হয়।

নতুন নীতিমালায় বাছাই ও নিয়োগ কমিটিতে আরো তিনজন সদস্য যুক্ত করে ছয় সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) করা হয়েছে সভাপতি। এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের দুজন প্রতিনিধিকে সদস্য রাখা হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিনিধির পরিবর্তে এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান নিজেরাও সরাসরি কমিটিতে উপস্থিত থাকতে পারবেন। বিগত দু বছরের কমিটিকে বৈধ আবেদনকারীদের মধ্য থেকে ২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করে শারীরিকভাবে যোগ্য তিনজনের একটি প্যানেল প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি বরাবর পাঠাতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু সংশোধিত নীতিমালায় বাছাই ও নিয়োগ কমিটিকে তিনজনের একটি তালিকা তৈরি করে দিতে বলা হয়েছে। এর মধ্য থেকে এমপি যাকে নিয়োগের সুপারিশ করবেন তাঁকেই নিয়োগ দিতে বলা হয়েছে নতুন নীতিমালায়। বলা হয়েছে, বাছাই ও নিয়োগ কমিটি বৈধ আবেদনকারীদের মধ্য থেকে তিনজনের একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন। তালিকাভুক্ত তিনজনই সমান যোগ্যতাসম্পন্ন বলে গণ্য হবেন। ওই তালিকা থেকে সংসদ সদস্য একজনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবেন। সংসদ সদস্যের সুপারিশই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। সংসদ সদস্যের সুপারিশ প্রাপ্তির পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনোনীত প্রার্থীর নাম সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পত্রযোগে জানিয়ে দেবেন। আগের নীতিমালায় নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে তদন্ত করার এবং তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জেলা শিক্ষা কমিটিকে তা নিষ্পত্তি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। সংশোধিত নীতিমালায় এ রকম অভিযোগ দায়েরের সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। নতুন নীতিমালা অনুসারে নিয়োগপ্রক্রিয়া হবে উপজেলাকেন্দ্রিক।

বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে এ নিয়োগের ক্ষেত্রে এমপি সাহেবদের কর্তৃত্ব পরোক্ষ ছিলো, এখন সরাসরি হলো। আগে যখন সরাসরি ক্ষমতা ছিলো না তখনো তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না, এখনো থাকবে না। বর্তমান নিয়োগপ্রক্রিয়ায় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের প্রতিনিধি যুক্ত হওয়ার ফলে ব্যাপকহারে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হলো।

ঝিনাইদহের শৈলকুপার গাড়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান তুর্কী বলেন, আগের ধাপে তাদের বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম প্রহরী নিয়োগ হয়েছে। তার মতে, নীতিমালা সংশোধন করে এমপিদের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাতে এ নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এটি একটি ভয়ানক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকে আরো পঙ্কিল করে তুলবে। নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দিলেও অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়। কিন্তু রাজনীতিবিদদের নিয়োগ কমিটিতে ঢোকানোর পর অনিয়ম বেড়ে যায়। তিনি বলেন, স্কুল-কলেজ পরিচালনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এসব প্রক্রিয়া থেকে রাজনীতিবিদদের দূরে রাখা দরকার।

দপ্তরি-কাম প্রহরী পদে নিয়োগপ্রার্থীদের যোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, প্রার্থীদের সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ক্যাচমেন্ট এলাকার (যেখান থেকে সহজলভ্য) স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। তবে ক্যাচমেন্ট এলাকার কোনো প্রার্থী পাওয়া না গেলে সে ক্ষেত্রে ক্যাচমেন্ট এলাকার পার্শ্ববর্তী ক্যাচমেন্ট এলাকার প্রার্থীকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। প্রার্থীর বয়সসীমা সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং সর্বোচ্চ ৩০ বছর। মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩২ বছর পর্যন্ত শিথিলযোগ্য। প্রার্থীর সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস। এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাইসাইকেল চালনায় পারদর্শী, সুঠাম দেহের অধিকারী পুরুষ প্রার্থীদের নির্বাচন করতে হবে। তাদের বেতন-ভাতা হবে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা।

আগের দু দফায় দপ্তরি-কাম প্রহরী পদে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে সারাদেশেই ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি-আর্থিক লেনদেনের ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। কোথাও বয়স জালিয়াতি করা হয়, কোথাও অন্য এলাকার প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, কোথাও আবার অধিক শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যারা দায়িত্ব পালন না করে কেবল বেতন উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব অনিয়ম নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আদালতে মামলাও হয়েছে। রংপুরের বদরগঞ্জের ১৭টি বিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগে মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার তিনটি ও নাচোলের দুটি বিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়েও মামলা হয়েছে। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায় এই পদের চাকরিপ্রার্থীদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে গুনতে হয়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরেও এ নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ জমা পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এছাড়া রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় ‘এমপি এনামুলের ডিওতে ৫০ দপ্তরি নিয়োগ, ২ কোটি টাকা ঘুষ আদায়ের অভিযোগ’ এবং ‘রাজশাহীর ১৯০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি পদে নিয়োগেই তিন লাখ টাকা!’ শিরোনামে গত বছর পৃথক দুটি প্রতিবেদন একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব জ্যোতির্ম্ময় বর্ম্মন আগের দু দফায় দপ্তরি কাম প্রহরী নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ উত্তাপিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ নিয়োগপ্রত্যাশী থাকে একাধিকজন। যারা বঞ্চিত হয় তারাই অনিয়মের অভিযোগ করে। বিগত দু বছর অনেক অভিযোগ জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে তিনি জানান। নতুন নীতিমালায় অভিযোগ দায়েরের সুযোগ না রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে এমপিদের সুপারিশই চূড়ান্ত। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নেই। তাই সেই সুযোগ রাখা হয়নি।