মে দিবস বেখাপ্পা মানসিকতা পরিহারে সহায়ক হোক

 

সভ্যতার আতুরঘরে অবশ্যই ছিলো মানুষের শ্রম। এক পক্ষের দিকনির্দেশনা অপর পক্ষের কায়িকশ্রমে সভ্যতার ইট একটি একটি করে গাথা হয়েছে। সেই গাথুনির মধ্যে, সভ্যতার শুরুতে রক্ত ঝরেছে, সভ্যতা যতো এগিয়েছে রক্ত ঝরার ধারাও ততো কমেছে। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ, কেউ দাস কেউ মালিক- কয়েক শতক আগেও ছিলো বিশ্বের, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়।

শ্রমিক যেন মানুষ নয়। ক্রীতদাস। সুতরাং তাকে দিয়ে শুধু উদয়াস্ত নয়, নিরন্তর শ্রমে-ঘামে সিক্ত করার বিষয়টি ছিলো সাধারণ ঘটনা। সেই ক্রীতদাসতুল্য মানুষের অধিক শ্রমের কোনো বাড়তি মূল্যও ছিলো না। ছিলো না তাদের ব্যক্তিগত জীবনও। পশ্চিমা বিশ্বে ঊনিশ শতকের শিল্প বিপ্লবের সময় অধিকাংশ শিল্পকারখানায় কাজের পরিবেশ ছিলো অস্বাস্থ্যকর, ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়াবহ। স্বাস্থ্যহীনতা ও মৃত্যুঝুঁকি ছিলো নিত্যসঙ্গী। কাজ করতে হতো ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৮ ঘণ্টার অধিক। এরপর এলো প্রতিবাদ, আন্দোলন এবং যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর ১৮৮৬ সালের পয়লা মে ইতিহাস সৃষ্টি করলো। নির্ধারণ হলো শ্রমিকের উপযুক্ত শ্রমঘণ্টা, শ্রমের মর্যাদা।

মে দিবসের ঘটনাটি না ঘটলে কার ক্ষতি হতো? সভ্যতা ও শ্রমিকের অন্তর্লোকের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, তা হলে, ক্ষতি হতো মালিক ও শ্রমিক- উভয়েরই। কেননা, মালিক পক্ষ এ গবেষণালব্ধ জ্ঞানটি তখনও বুঝে উঠতে পারেনি যে, অধিক শ্রমে ব্যক্তির কাজ করার ক্ষমতা বিনষ্ট হয়। ক্ষয় হয় সেই দক্ষ ব্যক্তির জীবনকালও। কেননা, সে মানুষ, যন্ত্র নয়। সুতরাং শ্রমঘণ্টা আট ঘণ্টা নির্ধারণ মানে শ্রমিকের পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া যথাযথ রাখা, যা পরবর্তী নিবিড় ও দক্ষ শ্রমের জন্য সহায়ক। শ্রমিক নিজেও একজন মানুষ, ফলে তার ব্যক্তিগত জীবনও আছে।

বিজ্ঞান যতো সম্প্রসারিত হয়েছে ততোই মানুষ শ্রমের বিনিময়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার বিষয়টি জাদুঘরে ঢুকাতে শুরু করেছে। যদিও আমাদের দেশে অধিকাংশ শ্রমিক ঠিকাদারের কাজে নিযুক্ত হলেও তারা নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেয় না। তার খেসারতও দিতে হয় শ্রমিকদেরই। উন্নত বিশ্বের শ্রম দিনদিন রোবট যন্ত্র নির্ভর হচ্ছে। সেই যন্ত্রই শ্রমিকতুল্য। যন্ত্রটির ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ব্যবহারবিধিতে স্পষ্ট করেছে যে, কাজের অধিক লোড দিলে তা বিগড়ে যেতে পারে। যন্ত্রটির কর্মকুশলতাও হ্রাস পেতে পারে। সুতরাং ওই যন্ত্রের মালিক নিশ্চয়ই যন্ত্রটিকে এমনভাবে ব্যবহার করবেন যাতে যন্ত্রটি সর্বোত্তম কার্যসম্পাদন করতে সক্ষম হয়। যন্ত্রটি যাতে দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকে, সেই দিকেও মনোযোগ দেয়া হয়। যন্ত্রটির কার্যক্ষমতা যদি আট ঘণ্টা পর হ্রাস পেতে শুরু করে তবে তাকে আঠারো ঘণ্টা পর্যন্ত কাজে না লাগিয়ে রিচার্জে বসানোর ব্যবস্থা করাই ভালো।

দিন বদলেছে। উন্নত বিশ্বে এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মালিক ও শ্রমিকের পার্থক্য অনেকটাই ঘুচেছে। শ্রমিক-মালিকের সম্পর্কটি বর্তমান বিশ্বে ক্রমশ একে-অন্যের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো- তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের শিল্পকারখানা এখনও সেই ঊনিশ শতকের মানসিকতা নিয়েই বেখাপ্পাভাবে বিকশিত। মে দিবসে এ মানসিকতা পরিহারে সহায়ক হোক।