শান্তিপূর্ণ সিটি নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের প্রত্যাশা ও শঙ্কা

 

স্টাফ রিপোর্টার: তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে যুগপৎ প্রত্যাশা ও শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারের সময় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার পরপরই বিদেশিরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের উদ্বেগের বার্তায় নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ দায়িত্ব পালনের তাগিদ থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিই ছিলো কূটনৈতিক মহলের মূল চাপ। সহিংসতামুক্ত নির্বাচন করার লক্ষ্যে ভূমিকা পালনের জন্য দুপক্ষের নেতাদের তাগিদ দিয়েছেন। অবশ্য প্রচারের শেষদিকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বস্তি প্রকাশও লক্ষণীয়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্থানীয় সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সোমবার টুইটারে লিখেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনই শক্তিশালী গণতন্ত্রের কেন্দ্রীয় বিষয়। আশা করি, আগামীকালের (আজ) নির্বাচন হবে সেই চেতনার দৃষ্টান্ত। ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন সোমবার পৃথক এক টুইটার বার্তায় বলেন, আশা করি ঢাকা ও চট্টগ্রামে আগামীকালের (আজ মঙ্গলবার) নির্বাচন সহিংসতা ও ভয়ভীতিমুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে যেখানে গণতান্ত্রিক পছন্দ প্রকাশের সুযোগ দেয়া হবে। জাতিসংঘ আগের দিনে দেয়া বিবৃতিতে প্রাক-নির্বাচনী সুষ্ঠু পরিবেশকে স্বাগত জানিয়েছে।

ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি শতাধিক পর্যবেক্ষকের পাশাপাশি বিদেশি দূতাবাসগুলো নজর রাখবে নির্বাচনের দিকে। বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিরা নিজেদের পর্যবেক্ষক না বলে সিটি নির্বাচন কিভাবে কাজ করে সেই সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ হিসেবে অভিহিত করেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনসহ বিভিন্ন দূতাবাসের এমন প্রতিনিধিরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনে ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করবেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রায় অভিন্ন ভাষায় নির্বাচনী প্রচারকালে সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। তার পরপরই উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। উদ্বেগের সুর ছিলো জাপানি দূতাবাস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া বিবৃতিতেও। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার পর প্রায় ১৬টি দেশের কূটনীতিকরা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি নিজের চোখে দেখে আসেন। নির্বাচনী প্রচারকালে এই হামলার বিষয়টি নিয়ে কূটনীতিকদের নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠক হয়। তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠক করে হামলা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অভিমত ব্যক্ত করেন।

জানা গেছে, নির্বাচন ঘিরে সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কূটনীতিকদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। উভয়পক্ষের সঙ্গে একত্রে মুখোমুখি বৈঠকও হচ্ছে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার বিষয়ে কূটনীতিকদের সামনে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঢাকায় সিটি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে এমন সহিংসতায় ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দার ভাষা ছিল অত্যন্ত কড়া। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও অহিংস নির্বাচনের ব্যাপারে যার যা দায়িত্ব তা পালনের তাগিদ দেয়। আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, অবাধে নির্বাচনী প্রচার ও সমাবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। প্রার্থীদের রাজনৈতিক সহিংসতার হাত থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্বও আইনশৃংখলা বাহিনীর। আইন ভঙ্গ করলে তার বিচারের ব্যবস্থা করতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র।

ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারকালে সহিংসতা উদ্বেগজনক। তিনি সহিংসতা এবং ভয়ভীতিমুক্ত নির্বাচনী প্রচারণার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সব রাজনৈতিক দল, আইনশৃংখলা বাহিনী এবং নির্বাচন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের ওপর জোর দেন। তিনি আশাবাদী যে নির্বাচনের দিন ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করতে পারবেন। তিনি বলেন, আমরা চাই, ভবিষ্যতে সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হোক।

নির্বাচনী প্রচারকালে সহিংসতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে কূটনীতিকদের বৈঠক এবং বিভিন্ন ধরনের তৎপরতার পর সহিংসতা অনেকটাই দূর হয়ে আসে। বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারের শেষদিকে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা বন্ধ হয়। তারপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্ক করে বলেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেয়র নির্বাচনের প্রাক্কালে কেউ এমন কিছু করবেন না যাতে আবার সহিংসতা হয়। সবাইকে এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইইউ আশা করে, রাজনৈতিক নেতারা শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবেন।

ইইউ তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ভোটারদের তাদের গণতান্ত্রিক পছন্দ প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। সহিংসতার সমাপ্তি ঘটানো, উত্তেজনা নিরসন এবং বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ভোটের ঠিক আগে জাতিসংঘের ঢাকায় অবস্থিত আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিনসের বিবৃতিতে সহিংস অবস্থা থেকে উত্তরণে খানিকটা স্বস্তি প্রকাশ পেয়েছে। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের লগ্নে সার্বিক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ বজায় থাকাকে স্বাগত জানাই। দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের দিনে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার জন্য ভোটারদের উৎসাহিত করি। তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘ স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানায়।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বার্ষিকীকে ঘিরে সৃষ্ট টানা তিন মাসের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর সিটি নির্বাচনকে সংকট উত্তরণের পথ মনে করছেন কূটনীতিকরা। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। ফলে নির্বাচনের প্রতি মুহূর্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ভোটের দিনে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার শতাধিক পর্যবেক্ষক মোতায়েন থাকবে। এছাড়াও ঢাকায় বিদেশী দূতাবাসের কূটনীতিকরা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।