চুয়াডাঙ্গাসহ সারাদেশে আবার ভূমিকম্প : ভবনে ফাটল দেখে কৌতুহল-আতঙ্ক

স্টাফ রিপোর্টার: পরশুদিনের দিনের ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববারও চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ সারাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বেলা ১টা ৯ মিনিট ৯ সেকেন্ডে এ ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। এর উত্পত্তিস্থল ছিলো নেপালের কোদারি থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, উত্সস্থলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিলো রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৭। ভূমিকম্পের সময় চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরে গতকালও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে চুয়াডাঙ্গা ভি.জে স্কুলের একটি ভবন, থানার সামনের একটি ভবনে ফাটল চোখে পড়লে আতঙ্কের মাত্রা বেড়ে যায়। তবে ফাটল পুরনো নাকি টাটকা তা নিশ্চিত করতে প্রকৌশলীরা পরীক্ষ-নিরীক্ষা শুরু করেছেন।

চুয়াডাঙ্গায় গতকাল ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার সাথে সাথে ব্যবসায়ীরা যেমন দোকানপাট ফেলে রাস্তায় অবস্থান নেন, তেমনই চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েও ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। পরে দেখা যায়, ভবনে ফাটল। এ ফাটল দেখে শিক্ষার্থীসহ অনেকেই বলেছেন, ভূমিকম্পের কারণেই এ ফাটল দেখা দিয়েছে। অবশ্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূর-ই আলম মোরেশর্দার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, ইঞ্জিনিয়ারদের ডেকে দেখানো হয়েছে। তারা বলেছেন, ওটা পুরাতন ফাটল। এরপরও আমরা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে বলেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীদের বাইরে বের করে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকেন শিক্ষকেরা। গ্রামবাংলা থেকেও ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এদিকে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার সামনের রূপালী ব্যাংক ভবনে ফাটল দেখে সড়কের উৎসুক জনতা ভিড় জমাতে থাকে। ভবনের মালিক পক্ষ অবশ্য জোর দিয়েই বলেছেন, ও ফাটল ভূমিকম্পের তো নয়ই, তেমন গুরুত্বপূর্ণও নয়।

এছাড়াও আলমডাঙ্গা কায়েতপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি বিল্ডিঙে ফাটল দেখা দিয়েছে। আতঙ্কে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ছেড়ে বাহিরে বেরিয়ে আসে।

কালীগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কালীগঞ্জের কোলাবাজার ইউনাইডেট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভূমিকম্প আতঙ্কে বিদ্যালয়ের ২য় তলা থেকে হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে ৭ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। তাদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাবজাল হোসেন জানান, রোববার দুপুর ১টা ১২ মিনিটের দিকে প্রায় ৩০ সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পের সময় ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ের ২য় তলা থেকে হুড়োহুড়ি করে নামার সময় মুসলিমা, সুইটি, অনামিক, পুজাসহ ৭ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। তাদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করানো হচ্ছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজয় কুমার জানান, তাদের বিদ্যালয় ভবন গত শনিবারের ভূমিকম্পে ফাটল দেখা দেয়। ঝুঁকির মধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নেয়া হচ্ছিলো। দুপুরে ভূম্পিকম্পের সময় ছাত্রছাত্রীরা নামতে গিয়ে তাড়াহুড়োয় ৭ জন শিক্ষার্থী পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে।

আন্দুলবাড়িয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জীবননগরের আন্দুলবাড়িয়া ইউনিয়নে জনমনে কিছুতেই ভুমিকম্প আতষ্ক কাটছে না। গতকাল রোববার ইউনিয়ন এলাকায় ফের ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বেলা ১ টা ৯ মিনিটের দিকে কয়েক সেকেন্ডের মৃদু ভূমিকম্প শুরু হলে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। আন্দুলবাড়িয়া বাজারের ডা. মীর আনিছুজ্জামান বলেন, লেখালেখি করাকালে ভূমিকম্পন শুরু হলে মাথা ঘুরতে থাকে।

ভ্রাম্যমা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গায় ভূমিকম্পনে হেলে পড়েছে একটি তিনতলা ভবন। গতকাল রোববার দুপুরে দু দফা ভূমিকম্পনে অনুভূত হয়। এ ভূমিকম্পনে কার্পাসডাঙ্গা বাজারের মুজিবনগর সড়কের ডা. নজীর আহম্মেদ প্লাজার পাশে সাবরেজিস্ট্রার শফিকুল ইসলামের হালসোনা মার্কেট নামক তিনতলা বিশিষ্ট ভবন হেলে পড়ে। এ সময় এই ভবনে বসবাসকারী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভবন থেকে ভাড়াটিয়ারা দ্রুত নিচে নেমে যান। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছেন, গতকাল রোববার দ্বিতীয় দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে জীবননগরে। দুপুর ১টা ৯ মিনিটের দিকে এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের কাঁপুনিতে আতঙ্কিত মানুষ বাড়ি-ঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। মুহূর্তের মধ্যে ভূমিকম্প হচ্ছে এ বুঝতে পেরে বিল্ডিং ছেলে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। এ সময় তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পর পর দু দিন ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় এখানকার মানুষের মাঝে চরমভাবে ভূমিকম্প আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

আমাদের ঢাকা অফিস জানিয়েছে, গতকালের কম্পনের তীব্রতা ছিলো আগের দিনের চেয়ে কম। তবে নেপালে শনিবারের ভূমিকম্পে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও দু হাজারের বেশি লোক নিহত হওয়ার খবরে আগে থেকেই আতঙ্কিত হয়ে ছিলো মানুষ। এর প্রভাব পড়ে গতকালের ভূমিকম্পের সময়। এদিন দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে একজন শেরপুরের এবং অন্যজন গাইবান্ধার। শেরপুরে নিহত ব্যক্তি সদর উপজেলার বেতমারী গ্রামের হায়দর আলী ওরফে নান্টু (৭৫)। তিনি ভূমিকম্পের কথা শুনে দৌড়ে ঘর থেকে বের হতে গিয়ে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। অন্যদিকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়নের চাচিয়া গ্রামে কৃষক আবদুল আউয়াল (৪৫) ভূমিকম্পের সময় মারা যান। আউয়াল বাড়ির পাশের ধানের জমিতে কাজ করছিলেন। হঠাত ভূকম্পন শুরু হলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

এছাড়া শনিবারের ভূমিকম্পের সময় ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নয়াহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আহত হওয়া এক ছাত্র, লালমনিরহাটে এক মাদরাসা শিক্ষক এবং পাবনার চাটমোহরের ছাইকোলা খাড়াপাড়া গ্রামে আহত হওয়া এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গতকাল রবিবার মারা গেছেন। অন্যদিকে গতকাল ভূমিকম্পের সময় সারাদেশের বিভিন্ন ইপিজেড, গার্মেন্টস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ভবন থেকে হুড়োহুড়ি করে বের হতে গিয়ে সহস্রাধিক লোক আহত হয়েছে। একই কারণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আতঙ্কে শতাধিক শিক্ষার্থী জ্ঞান হারায় বলে জানা গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু বাড়িঘর ও ভবনে ফাটল ধরা এবং হেলে পড়ার খবরও পাওয়া গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্তব্যরত এক পূর্বাভাস কর্মকর্তা জানান, ঢাকা থেকে এর কেন্দ্রস্থল ছিলো ৬শ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে আর ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে রাজধানীতে গতকাল অনেকেই ভবন ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলেও হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

আবহাওয়া বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, শনিবারের তীব্র ভূমিকম্পের পর এখন যেসব ভূকম্পন হচ্ছে সেগুলো ভূ-কম্পনের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া আফটার শক বা পরাঘাত। এগুলোর মাত্রা সাধারণত ততো বেশি হয় না। বড় ভূমিকম্পের পর অন্তত দু দিন বিভিন্ন সময়ে আফটার শক ঘটে থাকে। প্রথম উত্পত্তিস্থলের আশপাশেই আফটার শকের উত্পত্তি হয়ে থাকে।