ঢাকার আশুলিয়ায় ব্যাংকে সশস্ত্র ডাকাতদলের হানা : ম্যানেজারসহ নিহত ৮

টাকা তুলতে বিসিবিতে গিয়ে প্রিন্ট ব্যবসায়ী ঝিনাইদহ শৈলকুপার শাহাবুদ্দিন পলাশও হারালেন প্রাণ

 

স্টাফ রিপোর্টার: সাভারের আশুলিয়ায় গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ কর্মাস ব্যাংকে ডাকাতি করার সময় গুলিতে ম্যানেজারসহ সাতজন নিহত হয়েছেন। পালানোর সময় গণপিটুনিতে এক ডাকাত নিহত হয়। ডাকাতরা গ্রেনেড ও গুলি ছোঁড়ে। এ সময় আহত হন ১২ জন। হাতেনাতে ধরাপড়া এক ডাকাতের বাড়ি জয়পুরহাটে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্যদের ধরার জোরালো অভিযান শুরু হয়েছে।

ASULIA copy

নিহতরা হলেন- ব্যাংক ম্যানেজার ওয়ালিউল্লাহ, নিরাপত্তা প্রহরী বদরুল আলম, গ্রাহক পলাশ, মুদিদোকানদার মনির হোসেন, দোকানদার জিল্লুর রহমান, পথচারী জমির উদ্দিন ও ইব্রাহিম। ডাকাতরা মোটরসাইকেলযোগে পালানোর সময় জনতা মোটরসাইকেলসহ দু ডাকাতকে ধরে ফেলে। গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলে এক ডাকাত নিহত হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ব্যাংক থেকে লুট হওয়া ৫ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৫ টাকা। তবে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গ্রেনেড নয়, বোমা হামলা করা হয়েছে।

নিহত ব্যাংকের ম্যানেজারের বাড়ি জামালপুর জেলায়। তিনি সাভার আড়াপাড়ায় বসবাস করতেন। গুলিতে নিহত ব্যাংকের গ্রাহক সাহাবুদ্দিন পলাশের পিতার নাম শামসুদ্দিন মোল্লা। তার বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার লক্ষণদিয়া গ্রামে। তিনি কাঠগড়া এলাকার একটি প্রিন্টিং কারখানার মালিক ছিলেন। টাকা উত্তোলনের জন্য তিনি ব্যাংকে গিয়েছিলেন। গুলিতে নিহত ঝালমুড়ি বিক্রেতা মুনির হোসেনের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার কলাকুপাবান্দোরা এলাকায়। গুলিবিদ্ধসহ যারা আহত হয়েছেন তারা হলেন- পারভেজ, নুর ইসলাম, আয়ুব আলী, নুর মোহাম্মদ, শফিকুল ইসলাম, সাজ্জাদ আলী, সাইফুল ইসলাম, রমজান, শাহজাহান, আনিছ, আয়ুব আলী, সাইফুল ইসলাম, হামেদ আলী, শাহাজাদ, রফিক, আবদুল হক ও সালাম। তারা সকলেই সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।

ব্যাংকের শাখাটি আশুলিয়া কাঠগড়া সড়ক থেকে ২০ গজ ভেতরে। দোতলা ভবনের দোতলায় ব্যাংকটির অবস্থান। ব্যাংকে ম্যানেজারসহ স্টাফ সাতজন। এর মধ্যে নিরাপত্তাকর্মী একজন। লাঞ্চ আওয়ার। গ্রাহক দু থেকে তিনজন। ফলে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কোনো ধরনের তাড়া ছিলো না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৩-৪টি প্রাইভেটকারযোগে আসা ১০-১২ জনের একদল ডাকাত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাঠগড়া বাজারে অবস্থান নেয়। ডাকাতদলের মধ্যে তিনজন গ্রাহক সেজে প্রবেশ করে। পরে তারা ওই ব্যাংকের প্রধান ফটকের সামনে থাকা নিরাপত্তাকর্মী বদরুল আলমকে জিম্মি করে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। এ সময় ব্যাংক ম্যানেজারসহ অন্য  কর্মকর্তা ও ব্যাংকে থাকা গ্রাহকরা এগিয়ে এলে তাদের সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টার থেকে নগদ আনুমানিক ৬ লাখ টাকা লুট করে এবং ব্যাংকের ভল্ট ভাঙার চেষ্টা করে। এ সময় ব্যাংক ম্যানেজার পুনরায় বাধা দিলে ডাকাতরা তাকে এলোপাতাড়ি গুলি করলে ঘটনাস্থলেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ব্যাংকের ভেতরে ডাকাতির ঘটনাটি পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে মাইকে প্রচার করলে বাজারের দোকানদার, ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী ডাকাতদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। এ সময় ডাকাতরা ব্যাংকের ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতে করতে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যায়। এতে ব্যাংকের গ্রাহক গ্লোরি ফ্যাশনের মালিক পলাশ ও নিরাপত্তা কর্মী বদরুল আলম নিহত হয়। ডাকাতদল ব্যাংক থেকে বেরিয়ে জনতার সামনে পড়লে ডাকাত দল ফিল্মি স্টাইলে জনতাকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি বোমা ও গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মোটরসাইকেল যোগে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় ডাকাতদের গুলিতে মুড়ি বিক্রেতা মনির হোসেন ও ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান মারা যান। গুলি ও বোমার বিস্ফোরণে এলাকাবাসী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ সময় মুহূর্তেই বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায়ী ও বাজারে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ডাকাত দলের সদস্যরা টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পার্শ্ববর্তী জিরাবো-বিশমাইল সড়ক থেকে ডাকাত দলের দু সদস্যকে আটক করে এলাকাবাসী। এ সময় স্থানীয়দের গণপিটুনিতে ডাকাতদলের এক সদস্য ঘটনাস্থলেই মারা যায়। জনতা ব্যাংক থেকে  লুটে নেয়া টাকা ভর্তি একটি ব্যাগ উদ্ধার করে।

ঘটনার সময় উপস্থিত গ্রাহক রাশেদ সিকদার জানান, তিনি দুইটার দিকে ব্যাংকে টাকা উত্তোলন করতে আসেন। ১০-১৫ মিনিট পরই অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত একদল লোক ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে নিরাপত্তাকর্মীকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। তার চিত্কারে ম্যানেজার ও কর্মকর্তারা এগিয়ে গেলে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে তাদের সবাইকে জিম্মি করে। এরপরই তারা ব্যাংকের ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে ও  গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়।

ব্যাংকের ক্যাশ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসীরা ব্যাংকে ঢুকেই নিরাপত্তাকর্মীকে জিম্মি করে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। তাদের বাধা দিতে গেলে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ক্যাশ কাউন্টার থেকে আনুমানিক ৬ লাখ টাকা লুট করে ও ভল্ট ভাঙার চেষ্টা চালায়। এ সময় বাধা দিলে ডাকাতরা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এলাকাবাসী বলেন, ডাকাতরা লুট করে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা কয়েকজন একটি প্রাইভেটকার নিয়ে ডাকাতদের পিছু নেন। ঘটনাস্থল থেকে ৩শ গজ দূরে ডাকাত দলের দু সদস্যকে টাকাসহ আটক করতে তিনি সক্ষম হন।

ব্যাংক ভবনের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান বরকত জানান, আমাকে মোবাইল ফোনে একজন ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা জানালে আমি সাথে সাথেই ব্যাংকের পাশে মসজিদের ইমামকে মাইকে ঘটনা প্রচার করতে বলি। মসজিদের মাইকে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাটি প্রচার করলে বাজারে ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী এগিয়ে আসে। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজিম জানান, ডাকাতরা গ্রেনেড নয় বোমা হামলা করে। কয়েকটি পেট্রোল বোমাও উদ্ধার হয়েছে। ঘটনাটি তদন্ত চলছে। প্রকৃত ঘটনা অচিরেই উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেফতার সম্ভব হবে।

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান জানান, পলাতক ডাকাতদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে। আটককৃত ডাকাতের কাছ থেকে অন্য ডাকাতের তথ্য পাওয়া গেছে। জয়পুরহাট ও আশপাশের এলাকা ধরে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান, নিহত ডাকাতের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে আটক হওয়া ডাকাতের বাড়ি জয়পুরহাটে। তাকে নিয়ে ডাকাতদলের অপর সদস্যদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডাকাতরা জঙ্গি কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ডাকাতদলের অপর সদস্যকে উদ্ধার করতে গেলে পুলিশের সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় উত্তেজিত এলাকাবাসী পুলিশের দুটি গাড়িতে ভাঙচুর চালায় ও ডাকাতদের মোটরসাইকেলটি পুড়িয়ে দেয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ডাকাতির প্রায় ৪০ মিনিট পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে। এ নিয়ে পুলিশ ও এলাকাবাসীর মধ্যে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ডাকাত দলের আহত ওই সদস্যকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি করে।

জীবন দিলেন তবুও চাবি দেননি ম্যানেজার: গ্রেনেড ও গুলির ভয় দেখিয়েও ম্যানেজারের কাছ থেকে ভোল্টের চাবি নিতে পারেনি ডাকাতরা। ব্যাংকের ক্যাশ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, গ্রাহকবেশে কয়েকজন ডাকাত ব্যাংকে প্রবেশের পর ম্যানেজার ওয়ালিউল্লাহকে গ্রেনেড ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ভোল্টের চাবি দাবি করে। এ সময় তিনি চাবি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ডাকাতরা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে ক্যাশে থাকা টাকা ছিনিয়ে নেয়।

এদিকে ঘটনার পরপরই ৱ্যাব-পুলিশ ব্যাংক ও এর আশপাশ এলাকায় তল্লাশি শুরু করেব্যাংকের নিচে ও এর আশপাশ থেকে ৫টি গ্রেনেড উদ্ধার করেছে পুলিশএছাড়া, ব্যাংক থেকে পশ্চিম দিকে জিরাব-বিশমাইল সড়কের প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে বিভিন্ন স্থানে ডাকাতদের ফেলে যাওয়া শক্তিশালী বোমার সন্ধান পায়পরে ৱ্যাবের বোমা ডিসপোজাল ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুরো জায়গা ঘিরে ফেলেজনসাধারণের চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে ৱ্যাবপরে আজমত গ্রুপের সামনে থেকে শুরু করে সকল বোমা পর্যায়ক্রমে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিষ্ক্রিয় করে ৱ্যাবতখন বিকট শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে