চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিতে দর্শনা কেরুজ জৈব সার-কারখানা পরিদর্শনে জাতীয় সার কমিটির প্রতিনিধি দল

কেরুজ বর্জ্য পদার্থ হবে জাতীয় সম্পদ

 

বেগমপুর প্রতিনিধি: চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিতে দর্শনা কেরুজ চিনিকল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পরিবেশ বান্ধব জৈব সার-কারখানা পরিদর্শন করলেন জাতীয় সার কমিটির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলসহ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিচালক, জৈব সার-কারখানা প্রকল্প পরিচালক। গতকাল রোববার সকাল ৯টায় জাতীয় সার কমিটি ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল এ দর্শনা আকন্দবাড়িয়ায় জৈব সার-কারখানা পরিদর্শনে যান। কেরুজ জৈব সার-কারখানা প্রতিষ্ঠার ফলে চিনিকলের বর্জ্য পদার্থ পরিণত হবে জাতীয় সম্পদে। চাষিদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশের পরামর্শ প্রতিনিধি দলের। বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করার লক্ষ্যে দূরত্ব ছাড়পত্র দেয়ার আশ্বাস দিলেন প্রতিনিধি দল। উৎপাদিত এ জৈবসার চাষযোগ্য জমিতে ব্যবহারের ফলে মাটি ফিরে পাবে তার হ্রাস পাওয়া উপাদান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চিনিকলের বর্জ্য পদার্থ পাইপের মাধ্যমে মাথাভাঙ্গা নদীতে ফেলায় এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে দীর্ঘদিন থেকে নানা অভিযোগ করে আসছিলো এলাকাবাসী। অভিযোগের পাশাপাশি ৮০ দশক থেকে ভারত অভিযোগ করে আসছে মাথাভাঙ্গা নদীতে পড়া চিনিকলের বর্জ্য ভারতের চুন্নু নদীর পানি দূষিত করে। কেরু চিনিকল কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রণালয় থেকে জৈব সার-কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ দেয় ৭ কোটি ১৯ লাখ ১৩ হাজার টাকা। আর এ টাকা ব্যয়ে চিনিকলের পার্শ্ববর্তী আকন্দবাড়িয়া বীজ উৎপাদন খামারের নিজস্ব জমির ওপর গড়ে ওঠে জৈবসার কারখানা। জৈবসার কারখানার প্রকল্প পরিচালক (দর্শনা চিনিকলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক) এএসএম আব্দার হোসেনের তত্ত্বাবধানে এবং চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের সার্বিক সহযোগিতায় ৩০ ডিসেম্বর ২০১২ সালে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।

চিনিকলসূত্র জানায়, ৫০ কেজির প্যাকেটির এ সার বাজারজাত করা হলে ব্যাপক সাড়া মেলবে। এরই মধ্যে কেরুজ উৎপাদিত সার বাজারজাতকরণ, মূল্য নির্ধারণ ও গুণগতমান পরীক্ষার অনুমোদনের জন্য প্রায় দেড় মাস আগে এসআর ডিআই বরাবর আবেদন পাঠালে গতকাল রোববার সকাল ৯টার দিকে জৈবসারকারখানা পরিদর্শনে যান জাতীয় সার কমিটির তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। তিন সদস্য প্রতিনিধি দলের মধ্যে রয়েছেন- মৃত্তিকা গবেষক অধ্যক্ষ বক্তিয়ার হোসেন। অপর দুজন হলেন- মৃত্তিকা গবেষক ড. মহিউদ্দীন ও কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাহাবুবুল আমল। প্রতিনিধি দলের সাথে ছিলেন বিএসএফআইসি’র পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিচালক বিকাশ চন্দ্র শাহা, জৈবসার প্রকল্প পরিচালক সচিব এএসএম আব্দার হোসেন, কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরশাদ হোসেন। প্রতিনিধি দলের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করলে কয়েক দিনের মধ্যেই ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তখন উৎপাদিত এ জৈবসার বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করতে আর কোনো বাধা থাকবে না। তবে পরিপূর্ণভাবে কারখানাটি চালু হলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ রোধ হবে, অন্যদিকে কেরুজ চিনিকলের পেন্টেওয়াসের কারণে মাথাভাঙ্গা নদীর পানি দূষিত হবে না।

প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেন, চিনিকলের বর্জ্যপদার্থ হবে জাতীয় সম্পদ। কারণ জৈব পদার্থ মাটির প্রাণ। আদর্শ মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে মধ্যম মাত্রার জন্য মাটিতে শতকরা ১.৭-৩.৪ ভাগ জৈব পদার্থ থাকা কাম্য। বর্তমানে দেশের শতকরা ৩৯.৪১ ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ ভাগ বা এর কম এবং কোনো কোনো হিসাব মতে, তা শতকরা ০.৮০ ভাগ যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। শতকরা ৫৩.৮৬ ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২ ভাগ এর কম অর্থাৎ দেশের প্রায় শতকরা ৯৩.২৭ ভাগ জমিতে প্রয়োজনের চেয়ে কম জৈব পদার্থ রয়েছে। এ জৈব পদার্থ ঘাটতির কারণেই মাটি ঊর্বরতা হারাচ্ছে। জৈব পদার্থ মাটির ঊর্বরতা ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

জৈব সার ব্যবহারে মাটির গুণাগুণ উন্নত করে মাটির ঊর্বরতা বাড়ায়, অনু খাদ্য যোগ করে, ফসফরাস ফিক্সেশনে বাধা দেয়, খাদ্য উপাদানের স্টোর হাউস হিসেবে কাজ করে, বেলে মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও পুষ্টি উপাদান যোগ করে, এঁটেল মাটিকে ঝুরঝরা করে বায়ু চলাচল বৃদ্ধি করে, মাটিতে অনুজীবের কার্যকারিতা বাড়ায়, ভূমি ক্ষতিরোধ করতে সহায়তা করে, মাটির অম্লান নিরপেক্ষ রাখতে সহায়তা করে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, মাটির জৈব পদার্থের অবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল এবং মাটির উৎপাদনশীলতা রক্ষা করতে তা নিয়মিত পূরণ করা আবশ্যক।

শস্যচাষ এবং অপরিকল্পিত সার ব্যবহার ও অতিমাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। অপরিকল্পিত সার ব্যবহারের ফলে মাটিতে ক্ষতিকারক উপাদানের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাটির ঊর্বরশক্তি দিনদিন নিম্নমুখি হওয়ার অনেক কারণ থাকলেও তার মধ্যে রাসায়নিক সার ব্যবহার অন্যতম। কৃষিতে জৈব ব্যবস্থাপনা ফিরে এলে পরিবেশ সংরক্ষণ অনেকাংশে সহজ হবে। জৈব কৃষি নিয়ে কৃষকের মাঝে নানা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকের ধারণা জৈব কৃষি অর্থই জটিল কিছু। প্রকৃতপক্ষে চাষাবাদের কিছু সনাতনী পদ্ধতির সাথে আধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শ ঘটিয়ে পরিবেশ বান্ধব চাষাবাদকেই বলা হচ্ছে জৈব কৃষি। জৈব কৃষির মূল মন্ত্র হচ্ছে জৈব সার ব্যবহার।