২০ দলীয় জোটে ফাটলের আলামত : জামায়াত-বিএনপি স্নায়ুযুদ্ধ!

স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকার দু সিটির নির্বাচনে মুখোমুখি অবস্থানে জোট মিত্র বিএনপি ও জামায়াত। চট্টগ্রামে সমঝোতা হলেও ঢাকায় জামায়াতকে ছাড় দেয়নি বিএনপি। ছাড় না পেলেও নির্বাচনে এককভাবেই অংশ নিতে অনড় জামায়াত। বিএনপি-জামায়াতের ১৬ বছরের সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছে সিটি নির্বাচন।
মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন শীর্ষ নেতাদের মুক্তির আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন না পাওয়া, নেতাদের ফাঁসির রায় ও তা কার্যকর হলেও কানো প্রতিক্রিয়া না দেখানোয় বহুদিন ধরেই ক্ষোভ রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর। তার ওপর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার একলা চলো মনোভাব যেন আগুনে ঘি ঢেলেছে। শরিকের সাথে কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলেই আন্দোলন থেকে বিএনপির সরে আসা ও নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ক্ষুব্ধ জামায়াতে ইসলামীর অনেকে। এ সব নিয়ে দু দলের নেতাদের মধ্যে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। প্রায় তিন মাস ধরে চলা টানা অবরোধ কর্মসূচির শেষের দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আদালতে আত্মসমর্পণের পর জামিন পান। জামিন শেষে তিনি গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে না গিয়ে সরাসরি বাসায় চলে যান। এ নিয়ে জোটের কয়েকটি দলসহ ক্ষুব্ধ জামায়াতে ইসলামী। তারা প্রথমদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণও করতে চায়নি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে জামায়াতও নির্বাচনমুখি হয়। ১০ এপ্রিল বিএনপিপন্থি নাগরিকদের সংগঠন আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের পক্ষ থেকে ২০ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র, কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। তাতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের ৯৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৮৫ জন এবং দু সিটির ৩১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ২৯ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য নুরুল ইসলাম বুলবুলের অভিযোগ, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়নে কোনো আলোচনাই হয়নি। শরীকদের সাথে কথাবার্তা ছাড়াই ২০ দলের প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
জামায়াতের ঢাকা সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির এই আহ্বায়ক আরও অভিযোগ করেন, আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ও সদস্য সচিব শওকত মাহমুদ স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ২০ দলের কাউন্সিলর প্রার্থীদের নামের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেই তালিকা সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামী অবহিত নয়।
জাট সূত্র জানায়, গত সোমবার রাতে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে ২০ দলের শরিক কয়েকজন নেতা দেখা করেন। জামায়াতের সাথে আলোচনা না করেই সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী ঘোষণা করায় জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়েছে এ নিয়ে কথা ওঠে সেখানে। এক পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। সেখানে উপস্থিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে এ বিষয়ে জামায়াতের সাথে কথা বলতেও নির্দেশ দেন বেগম খালেদা জিয়া।
শীতল সম্পর্কের শুরু যেভাবে: বিএনপি-জামায়াত সূত্র জানায়, জোটের বড় দুই শরিক বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল অনেক দিন থেকেই। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে আদালতের দেয়া রায় সম্পর্কে বরাবরই বিএনপির রহস্যজনক নীরবতা এবং জামায়াতের ডাকা হরতালে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন না জানানোয় বেশ ক্ষুব্ধ হয় রাজনৈতিকভাবে চাপে থাকা দলটি।
সর্বশেষ গত ১১ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। এ নিয়ে জামায়াত তিন দিনের (আগে-পরে) হরতাল কর্মসূচি পালন করলেও বিএনপি বরাবরের মতোই চুপ থেকেছে। এর আগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ না করা এবং কিছুদিনের মাথায় দলটির আমির মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া নিয়ে বিএনপির নীরবতায়ও ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত।
সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো জামায়াত ছাড়তে বিএনপিকে বার বার পরামর্শ দিচ্ছে। দলের মধ্যেও এ নিয়ে একটি অংশের চাপ রয়েছে। তবে বেগম খালেদা জিয়া সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। অন্যদিকে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের ওপরও জোট ছাড়তে চাপ বাড়ছে দলের তরুণ নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে। তবে, জামায়াত বিএনপিজোট ছেড়ে নতুন করে আর বেঈমানির কাঁদা গায়ে মাখাতে চাচ্ছে না। বরং বিএনপির পক্ষ থেকে যদি জোট ছাড়তে বলা হয় তবেই তারা এককভাবে বা অন্যকোনো জোট গঠনে মনোযোগী হবে বলে জানা গেছে। জামায়াতের সাথে আলোচনা ছাড়াই আদর্শ ঢাকা আন্দোলন নামে বিএনপিপন্থি সংগঠনটি ঢাকার দু সিটির ২০ দলের কাউন্সিলর প্রার্থী ঘোষণা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মে. জে.(অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, এ নিয়ে আমার বক্তব্য নেই। আমি বলবো ঘোষিত প্রার্থীদের পক্ষে ২০ দল কাজ করবে। তাদের সাথে শত নাগরিক কমিটি, সিভিল সোসাইটি এবং দুই মহানগরের ভোটার ও নাগরিকরা আছেন।
তিনি বলেন, আমার মনে হয় জামায়াতের সঙ্গে আমাদের (বিএনপির) মিলিয়ে দেখা উচিত হবে না। কারণ তাদের আলাদা একটা পলিটিক্যাল এজেন্ডা আছে। বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল। আমরা মডার্ন গণতান্ত্রিক দলের অনুসারী। তাই বিএনপির সাথে জামায়াতকে একসাথে মিলিয়ে দেখার সুযোগ নেই। ২০ দলে আরও ১৯টি দল আছে। তাহলে কী বলা যাবে জামায়াতের সাথে বিএনপির নানা কারণে দূরত্ব বেড়েছে? এমন প্রশ্নে মাহবুবুর রহমান বলেন, না-না অসুবিধা নেই। আমরা আপন আপন দলের গঠনতন্ত্র, রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা নিয়ে আছি।