গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ

হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার কর আমারে..গানের রচয়িতা

 

অ্যা. সিরাজ প্রামাণিক: উনবিংশ শতাব্দির আলোকিত সাংবাদিক হিসেবে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গতকাল ৫ বোশেখ ছিলো তার ১১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ১২৪০ সনের ৫ শ্রাবণ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী এলাকার কুণ্ডুপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। দেহত্যাগ করেন ১৩০৩ সনের ৫ বোশেখ। এবারের মৃত্যুবার্ষিকীও অনেকটাই নীরবে কেটে গেলো।

KANGAL-3

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকার সম্পাদক গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের স্বপ্নের ছোঁয়া কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ার সর্বত্রই যেন বিরাজমান। শত বছর আগের সেই স্মৃতি চিহ্ন বাস্তুভিটায় আজ খুঁজে পাওয়া বড়ই দুস্কর। এতোদিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চরম অনাদর আর অবহেলায় পড়ে থাকা তার কুষ্টিয়ার কুমারখালী কুণ্ডুপাড়ার বাস্তুভিটায় সরকারি উদ্যোগে অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি ও মিউজিয়াম নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও কাঙাল স্মৃতি কমপ্লেক্স ব্যতীত কোনো প্রকল্প আজও বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও মহান এ সাংবাদিকের বাস্তুভিটেয় সে সময়ের ঘরবাড়ির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ভার। স্মৃতি বলতে অবশিষ্ট রয়েছে ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্র, এমএন প্রেস, হাত মেশিন, বাংলা টাইপ ও হরিনাথের কিছু পাণ্ডুলিপি।

KANGAL-1

কুষ্টিয়ার কুমারখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরু পিচঢালা পথ চলে গেছে কুণ্ডুপাড়ার দিকে। পাকা সড়ক ছেড়ে খানিকটা হেঁটে যেতে হয় সরু মেঠোপথ ধরে। তার পরই দেয়ালের পলেস্তারায় আঁচড় কেটে ‘এমএন প্রেস’ লেখা বাড়িটি। যেকোনো সময় হুড়মুড় করে ধসে পড়ার ঝুঁকি নিয়েই রুগ্ন চেহারায় কোনোরকম দাঁড়িয়ে। নোনা ধরে পলেস্তারা খসে গেছে। চাল নড়বড়ে। বাঁশের খুঁটির ঠেস দিয়ে বারান্দা, ঘরের চাল আটকে রাখা। তবে আশপাশের পরিবেশ মনোরম। বাড়িতে থাকেন যে প্রৌঢ়, তিনিও বাড়িটির মতোই বয়সের ভারে দুর্বল। নাম অশোক মজুমদার। পাঁচ পুরুষ ধরে তাদের এ বাড়িতে বসবাস। দর্শনার্থীরাও আসে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্র নামের যে যন্ত্রটিতে তিনি ১৮৭৩ সালে গ্রামবার্তা ছাপিয়ে ছিলেন, সেটি দেখতে। যুক্তরাজ্যে তৈরি যন্ত্রটিতে যদিও মাকড়সার জাল আর ধুলার স্তর জমে আছে, তবু এখনো এটি ছাপার কাজের উপযোগী বলে জানালেন অশোক বাবু। তিনি হরিনাথ মজুমদারের প্রপৌত্র। এ প্রেসটি নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। তাই এখনো কুমারখালীতে গেলে প্রেসটি এক নজর দেখে আসার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না দর্শনার্থীরা। প্রাচীন বাংলার মুদ্রণ জগতের প্রথম ছাপাখানা এমএন প্রেসের বিবর্ণ অবস্থা দেখে ভীষণ কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছেন অনেক ঐতিহাসিকরাও। অথচ জীর্ণশীর্ণ পরিবেশে দর্শনীয় ঐতিহাসিক এ ট্রেডল মেশিনটির ছাপা অক্ষর এক সময় ব্রিটিশ রাজ্যের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কথা বললেও আজ হরিনাথ মজুমদারের উত্তরসুরিদের পারিবারিক জমি সংক্রান্ত কোন্দলের শিকারে অমূল্য এ নিদর্শনটি ভাঙা ঘরের একপাশে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। মাথায় কোনো চাতাল বা ঢাকনা নেই। রোদ-বৃষ্টি, ঝড় সব ওই খোলা মাথার ওপর দিয়েই যাচ্ছে। কয়েকটি ভাঙা টিন আর পলিথিনের পেপার দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে ছাপার মেশিনটা। ওপরে কোনো ছাদ না থাকলেও প্রায় ধসে পড়া শত বছরের পুরনো ঘরের দরজায় বেশ বড় একটি তালা চোখে পড়ে। বছরখানেক আগে যে রকম ছিলো তার চেয়ে এখন এর অবস্থা আরো করুণ।

হরিনাথ মজুমদারের জন্ম ১৮৩৩ সালে, মৃত্যু ১৮৯৬ সালে। অল্পবয়সেই তিনি পিতা-মাতাকে হারিয়েছিলেন। স্থানীয় ইংরেজি স্কুলে পড়ালেখা শুরু। তবে অনাথ হয়ে পড়ায় আর্থিক দুর্গতিতে বেশিদূর এগোতে পারেননি। বিদ্যানুরাগ ছিলো প্রবল। সমাজ-সচেতনতাও প্রখর। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ সালে এ বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এদেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা অন্যতম পথিকৃতের।

স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজদের প্রজাপীড়ন ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছিলো হরিনাথকে। ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় এসব নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। সেই তার সাংবাদিকতার শুরু। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই প্রকাশ করেন গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামের মাসিক পত্রিকা। পরে এটি পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। গ্রামবার্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কোলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এ যন্ত্রেই গ্রামবার্তা প্রকাশিত হতে থাকে। ২৫ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিলো। মেশিনের মাঝখানে এ যন্ত্রটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনের তারিখে লেখা রয়েছে। লন্ডনের ১০ ফিন্সবারি স্ট্রিটের ক্লাইমার ডিক্সন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে কলম্বিয়ান প্রেস মডেলের ১৭০৬ নম্বর এ মুদ্রণযন্ত্রটি তৈরি করা হয় ১৮৬৭ সালে। প্রয়াত এডওয়ার্ড বিভান এ যন্ত্রটি পেটেন্ট করেন। অমৃতবাজার পত্রিকার বাংলা ১২৮০ সালের ১৭ শ্রাবণ সংখ্যায় কুমারখালীতে কাগজ ছাপাকল বসার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সে খবর লোকমুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অসংখ্য লোক তাই দেখতে আসে কেমন করে কাগজের গায়ে অতো ছোট লেখা হয়। ৩০-৩৫ মণ ওজনের ডাবল ক্রাউন সাইজের বিশাল মেশিন। দেখতে একটি দানবের মতো। এ মেশিনে কাগজ ছাপাতে তিনজন লোক লাগতো। মেশিন চলাকালে দেখা যেতো মেশিনের মাথার ওপর ডানা প্রসারিত ঈগল পাখিটা উড়ে গিয়ে আবার যথাস্থানে ফিরে আসছে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় প্রতিদিনই দর্শনার্থীরা এ প্রেস দেখতে যেতেন। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কোনোদিন কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেখা হয়নি। পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দু পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠিরের হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মানবদরদী ও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে সেখানেও বেশি দিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠিরে স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়ত-প্রজার ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ নিজ চোখে দেখেন। কাঙালের জীবনীকার অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর মতে, এ শোষণের প্রতিকারের চিন্তা থেকেই পরে হরিনাথ মজুমদার গ্রামবার্তা প্রকাশিকা সম্পাদনা করেন। গণসঙ্গীত শিল্পী কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথের আগে ঠাকুর পরিবারের যেসব সদস্য জমিদার হিসেবে শিলাইদহে এসেছিলেন, তারা প্রজাবৎসল ছিলেন না। তাদের অত্যাচারের কথা হরিনাথ গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় সাহসের সাথে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রিয় বন্ধু কাঙালকে শায়েস্তা করতে পাঞ্জাবি লাঠিয়ালদের কোলকাতা জাঁকিয়ে দিয়েছিলেন।

গ্রামবার্তা পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশ করেন। একটা পর্যায়ে জমিদারেরা তার ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তখন লালন সাঁই অনুসারীরা হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাকে রক্ষা করেন।

ফকির লালন সাঁইয়ের সাথে হরিনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিলো। এছাড়া বিষাদ সিন্ধু ও জমিদার দর্পণের রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্র কুমার রায়রা ছিলেন তার শিষ্যতুল্য এবং গ্রামবার্তার লেখক। হরিনাথ নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক। কাঙাল ফকির চাঁদ বাউল নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বহু গান লিখেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ১৮টি। এর মধ্যে ‘বিজয় বসন্ত’ নামের উপন্যাসটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলো। এর ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো তার জীবদ্দশাতেই।

পূর্বপুরুষের আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে পারেননি অশোক মজুমদার। তিনি জানালেন, ১৯৭১ সালে প্রেসঘরটির ওপরে পাকিস্তানি হানাদারেরা বোমা ফেলেছিলো। যন্ত্রটি রক্ষা পেলেও ঘরের ছাদ দেয়াল ভেঙে যায়। মেরামত করার সামর্থ্য নেই। এখানেই মাথা গুঁজে আছেন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। ডবল ক্রাউন সাইজের কাগজে এ মুদ্রণযন্ত্রটিতে সারাদিনে প্রায় এক হাজারটি ছাপ দেয়া যায়। যে যন্ত্রে কাঙালের হাতের স্পর্শ, লালনের হাতের স্পর্শ, মীর মোশাররফ, জলধর সেনের হাতের স্পর্শ, সেখানে আমি হাত রাখতে পেরেছি, এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কি আছে, বলছিলেন অশোক। সে কারণেই যন্ত্রটি বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন।

‘কাঙাল’ বলেই সবার কাছে পরিচিত হরিনাথ মজুমদার। অশোক বাবু জানালেন, কাঙাল হরিনাথের একটি গান সত্যজিৎ রায় ব্যবহার করেছিলেন তার বিখ্যাত পথের পাঁচালী ছবিতে। কিন্তু গানটি কার সে উল্লেখ ছিলো না ছবির পরিচিতি অংশে। পরে এ সম্পর্কে জেনে চিঠি লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। খুব পরিচিত গান। পথের পাঁচালীর আবহ সঙ্গীতে ঘুরেফিরে ব্যবহৃত হয়েছে, আর ইন্দির ঠাকরুনের ভূমিকায় চূনীবালা গেয়েছিলেন গানটি ‘হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো পার কর আমারে…। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি বলে লোকশিক্ষার প্রতি হরিনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিলো। কোলকতার বাইরে দূরে মফস্বলে সংস্কৃতিচর্চার একটি অনুকূল আবহাওয়া রচনা করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু উপার্জনের নির্দিষ্ট উৎস না থাকায় আর গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রকাশের জন্য চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রায় কাঙাল হয়ে পড়েন। কাঙাল হয়েও তিনি যা রেখে গেছেন তা এখনও গ্রামীণ সাংবাদিকদের কাছে আদর্শ।