নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা নজরদারিতে র‌্যাবসহ বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনী

মাথাভাঙ্গা মনিটর: র‌্যাবসহ বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ওপর গোপন নজরদারি করছে নিউজিল্যান্ডের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশনস সিকিউরিটি ব্যুরো (জিসিএসবি)। তাদের সহযোগিতা করছে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জিসিএসবি গোপনে ওই নজরদারি করে আসছে। নিউজিল্যান্ডের গণমাধ্যম নিউজিল্যান্ড হ্যারল্ড-এ বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। একই দিন রেডিও নিউজিল্যান্ডনিউজ এ বিষয়ে পৃথক রিপোর্ট করেছে। এতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জন কীর মন্তব্য প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের ওপর জিসিএসবির নজরদারির বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রধানমন্ত্রী জন কী।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আমরা বিষয়টি পত্রিকায় ও টেলিভিশনের খবর দেখেছি। আমরা এর বাইরে কোনো তথ্য অবগত নই।

র‌্যাবসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জিসিএসবির নজরদারির বিষয়ে শুক্রবার বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি নিউজ চ্যানেলে এ খবর প্রচার করা হয়। এ খবরে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা কাজে র‌্যাবের সহযোগিতা করে জিসিএসবি। সহযোগিতার আড়ালে র‌্যাবের নিজস্ব টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায়ও আড়ি পেতেছে সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে মার্কিন পত্রিকা দি ইন্টারপেস্টের সাংবাদিক রায়ান গ্যালাঘার ওই টেলিভিশনকে বলেন, এক দশক ধরে চলছে বাংলাদেশে আড়িপাতার ঘটনা।

যমুনা টেলিভিশনের খবরে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালে জিসিএসবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি ফাঁস হওয়া গোপন নথি বলছে র‌্যাবের নিজস্ব ভয়েস যোগাযোগ ব্যবস্থায় আড়িপাতার যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। র‌্যাবের মাইক্রোওয়েব স্টেশন ও নেটওয়ার্কের মানচিত্রও তুলে ধরেছে জিসিএসবি। শুধু ভয়েস যোগাযোগ নয় জিসিএসবি আড়ি পেতেছে র‌্যাবের ডিজিটাল যোগাযোগেও। র‌্যাব সদর দফতরের সাথে ৩ কার্যালয়ের ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের একটি ছবিও দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। জিসিএসবির দাবি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে, কাজে লাগাবে নজরদারির তথ্য। শুধু র‌্যাব নয়, জিসিএসবি নজরদারি করছে আরও অনেকের মোবাইল যোগাযোগে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এনএসএর একটি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতায় ২০০৪ সাল থেকেই গোয়েন্দা সম্প্রদায়গুলোর নেতৃত্ব দিয়ে আসছে জিসিএসবি। এ তথ্যের ভিত্তিতে সফল সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালিয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইএ ও ভারত। তবে বাংলাদেশের হাতে এসব তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনেছে নিউজিল্যান্ডের গণমাধ্যম। বাংলাদেশে নজরদারির বিশদ বিবরণে পুরান ঢাকার নারিন্দায় পাকিস্তানি একটি হ্যান্ডসেট শনাক্তেরও তথ্য দেয়া হয় ওই প্রতিবেদনে।

নিউজিল্যান্ড হ্যারল্ডে প্রকাশিত প্রতিবেদন: নিউজিল্যান্ড হ্যারল্ডে কিউই এজেন্সি শেয়ার্ড ইন্টেল উইথ ঢাকা শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী সম্পর্কে গোপনে নজরদারি করে তথ্য সংগ্রহ করেছে নিউজিল্যান্ড। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিষয়গুলো নজরদারি করেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে এ কাজ করেছে নিউজিল্যান্ড, যা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর চালু হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) ২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, জিসিএসবি ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার ওপর গোপন নজরদারি করছে। জিসিএসবি বাংলাদেশের ওপর গোপন গোয়েন্দা তৎপরতার তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগকে (এনএসএ) সরবরাহ করেছে। বাংলাদেশে জিসিএসবির গোপন তৎপরতা খুবই বিস্ময়কর এবং অস্পষ্ট জায়গা থেকে পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে পররাষ্ট্র সম্পর্ক খুব বেশিদিনের নয়। নিউজিল্যান্ড সরকারের মতে, বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব বিদ্যমান। নিউজিল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের সময় ২০০৩ সালে বাংলাদেশের ওপর গোপন নজরদারি শুরু করে জিসিএসবি। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে এনএসএর সম্পর্ক নিয়ে বলা হয়, এনএসএর একজন কর্মকর্তা ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে জিসিএসবিকে একটি ব্রিফিং নোট দেন। তাতে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসেবে উগ্র ইসলামী চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। বিশেষ করে এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলের বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওপর।

২০০৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মোবাইল কথোপকথনের তথ্য (ইন্টারনাল জিএসএম) ধারবাহিকভাবে এফ-৬ নামে পরিবেশগত জরিপের জন্য পাঠানো হয়। এফ-৬ নামে পরিবেশগত জরিপ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ ও এনএসএর বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারি।

প্রতিবেদনটিতে ২০১৩ সালের এনএসএর প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডের ওপর জিসিএসবি চমৎকার তথ্য সংগ্রহ করেছে। গোয়েন্দা প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশে একাধিক সংস্থা কাজ করে থাকে। যার মধ্যে ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের বিশেষ শাখা রয়েছে। এছাড়া র‌্যাব মূলত বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনে মূল দায়িত্ব পালন করে আসছে। তবে বাংলাদেশের এ সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অনেক বছর ধরেই মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০০৮ সালে অভিযোগ করে বলে, ঢাকার মগবাজারের পাশে অবস্থিত পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) প্রধান কার্যালয়ে আটক ব্যক্তিদের নির্যাতন করা হয়।

এনএসআই ২০১০ সালে ট্রেড ইউনিয়নের একজন কর্মীকে আটক করে নির্যাতন ও মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ওই একই ব্যক্তিকে দু বছর পর অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মৃত হিসেবে উদ্ধার করা হয়। ওই ব্যক্তির পা ও আঙুলগুলো ভাঙা ছিলো।

বিশেষজ্ঞ মতামত: এ প্রতিবেদন সম্পর্কে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, কোনো দেশের গোপনভাবে অন্য দেশের ওপর নজরদারি বা গোয়েন্দা অপতৎরতা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। এটি করতে গেলে দু দেশের মধ্যে চুক্তিভিত্তিক হওয়া উচিত। গোয়েন্দা নজরদারি যদি বাংলাদেশের স্বার্থে হয় তাহলে আমরা বলবো পজিটিভ। যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হয় বা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য হয় তাহলে আমরা ক্ষুব্ধ। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলেন।