ঢাকার রামপুরায় টিনের দোতলা দেবে মৃত ১১ জনের লাশ উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানী ঢাকার রামপুরায় একটি দোতলা টিনশেড ঘর ঝিলপাড়ে দেবে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১১ জন। রামপুরা থানার পূর্ব হাজিপাড়া এলাকায় বৌবাজার মাটির মসজিদ সংলগ্ন বেগের বাড়ি ঝিলর ওপর খাসজমিতে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছিলো এ দোতলা টিনের ঘরটি। সেখানে ছিলো তার ২৪টি কক্ষ। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা বাশের সাঁকো পেরিয়ে যেতে হয় এসব ঘরে। গতকাল বুধবার বেলা ৩টার দিকে মুহূর্তের মধ্যেই নিচতলার ১২টি ঘর পানিতে ডুবে গেছে। ভবনের বাসিন্দারা কেউ কেউ সাঁতরে তীরে উঠে যেতে পারলেও সলিল সমাধি হয়েছে বহু মানুষের। রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্থানীয় জনতা ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ১১ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। তাদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিখোঁজ ও নিহত মানুষের আহাজারিতে গোটা এলাকার আকাশ ভারি হয়ে ওঠে। অবতারণা হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। মর্মান্তিক এ ঘটনায় শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ইন্সপেক্টর নিলুফার ইয়াসমিন জানান, বেলা সাড়ে ৩টায় তারা ঘরগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ার খবর পান। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। তিনি আরও বলেন, ডুবে যাওয়ার সময় ভবনের অধিকাংশ বাসিন্দা তখন বিশ্রামে ছিলো। ফলে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সব ঘর সরিয়ে ফাইনাল সার্চ না দেয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাবে না সেখানে আর কতো লাশ আছে। তিনি আরও জানান, রাত সাড়ে ৯টার সময় একটি বড় ক্রেন এনে ঘরগুলো টেনে তোলার কাজ শুরু হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের ডুবরি মাসুদল হক ও আলমগীর হোসেন উদ্ধার অভিযান চালাকালে জানান, তারা প্রথম তলার ৫টি কক্ষে চালের টিন কেটে দু নারীর লাশ বের করে এনেছেন। ঝিলটি সাত থেকে আট ফুট গভীর। ঘরের প্রতিটি কক্ষ হাঁড়ি-পাতিল, চৌকি-খাট, লেপতোশক, টেলিভিশন, লাঠিসহ বিভিন্ন মালামালে ঠাসা। পচা পানির কারণে ঘরের ভেতর প্রবেশ করা ও তল্লাশি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে কোনো লাইট পানির নিচে কাজ করে না। ফলে সহজেই উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা একপাশ থেকে শুরু করে টিন সরিয়ে ও এঙ্গেল কেটে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন।

নিহতদের মধ্যে ১০ জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- সাজিদা খাতুন (১৯), সাইফুল ইসলাম (১৪), হারুনুর রশিদ (৪৫), কল্পনা বেগম (৪৫), রুনা (১৬), রুখসানা খাতুন (২২), মিজানুর রহমান (৩৫), ফারজানা (১২) ও তার নানী রূপসী (৫৫) ও জাকির (৯)। এছাড়া অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়েছে।

ওই বাড়ির নিচতলার বাসিন্দা গার্মেন্টকর্মী হাসি বেগম ও জুতোর দোকানের কর্মী ইদ্রিস আলী জানান, বেলা ৩টার দিকে কয়েকবার ঘরটি নড়ে ওঠে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘরটি মুহূর্তের মধ্যেই ঝিলের পানির নিচে তলিয়ে যায়। হাসি তার নাতি ও মেয়েকে নিয়ে কোনো মতো সাঁতরে বের হয়ে আসেন। ইদ্রিস আলী জানান, তিনি বের হয়ে আসতে পেরেছেন; কিন্তু স্ত্রী ও নাতনি আটকা পড়েছে।

অপর বাসিন্দা রোজিনা খাতুন জানান, তার শাশুড়ি ফাতেমা. শ্বশুর শহিদুল, ছোট তিন দেবর জাহিদ, ইউসুফ ও এনামউদ্দিন নিচতলার একটি কক্ষে চার হাজার টাকায় ভাড়া থাকতেন। ঘর ডুবে যাওয়ার পর টিন কেটে শ্বশুর শহিদুল, দেবর জাহিদকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার শ্বশুর রাজমিস্ত্রির কাজ করেন বলে জানান রোজিনা।

অপর ঘরের বাসিন্দা খলিলুর রহমান জানান, তার ছেলে ছাইফুল ইসলাম মারা গেছে। খলিল শেখ দেবে যাওয়া বাড়ির নিচতলায় থাকতেন। সাইফুলের বয়স ১৪। সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তো। সাইফুল, তার শেফালী ও অপর ছেলে আরিফকে নিয়ে নিচতলায় থাকতেন। ছেলের জন্য তার মাতমে এলাকায় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। অপর বাসিন্দা আলতাফ মিয়া জানান, বেলা পৌনে ৩টার দিকে দুপুরের খাবার শেষে অনেকেই ফিরে গেছেন নিজ নিজ কাজে। আবার অনেকে নিচ্ছিলেন বিশ্রাম। ঠিক তখনই ঘটে গেলো মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা। সবাই আল্লাহগো বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করেন। তিনি দোতলা থাকায় বের হয়ে আসতে পেরেছেন। ঘর ধসে পড়ার খবরে হাজার হাজার উৎসুক মানুষ ঘটনাস্থলে যান। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে শুরু করেন উদ্ধার কাজ। ঘটনাস্থলে রামপুরা থানার ওসি মাহবুবুর রহমান জানান, উদ্ধার করা লাশগুলোর নাম-ঠিকানা রেখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে।

ঢাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি) তোফাজ্জল হোসেন মিয়া গতকাল বুধবার রাতে জানান, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া দাফন করতে প্রতিটি লাশের জন্য ২০ হাজার টাকা এবং চিকিৎসার জন্য আহত প্রতিজনকে ৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।