চুয়াডাঙ্গা বড়বাজারের প্রবেশ পথের উল্টো দিকে দু পায়ে দাঁড়িয়ে মূল্যতালিকার বোর্ড
আলম আশরাফ: কোনো দ্রব্যের হঠাৎ দাম বেড়েছে? সেদিক থেকে মুখ ফেরানোর বদলে তা কেনার জন্য অধিকাংশ ভোক্তাই প্রতিযোগিতায় নামেন। সে ইলিশের ক্ষেত্রেই হোক, আর চিনি-লবণের বেলায় হোক। চড়া দামে কিনতে পারার তৃপ্তি নিয়ে কেউ কেউ বাড়ি ফিরে গিন্নিকে খুশি করলেও এ রেওয়াজ যে অধিকাংশ ভোক্তারই গলার কাঁটা তা ক’জনই আর ভাবেন? গতকাল রোববার চুয়াডাঙ্গার তরিতরকারির বাজার থেকে শুরু করে মুদিদোকানে সরেজমিন তথ্য নিতে গেলে সচেতন এক ভোক্তা এসব মন্তব্যমাখা প্রশ্ন তুলে বলেন, বাজারের চেনা এ ছবি বদলাতে কলম সৈনিকদের পোক্ত হাতে কলম ধরা দরকার।
চুয়াডাঙ্গা বড়বাজার নিচেরবাজারের প্রবেশ মুখের বিপরীতে বড় করে লাগানো হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যতালিকার ফলক। প্রবেশের সময় ওটা চোখে না পড়লেও বাজারের থলে নিয়ে ফেরার সময় রিকশার পেছনের বোর্ডটি চোখ এড়ানোর কথা নয়। গতকাল রোববার সকাল থেকে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা সেখানে ক্যামেরা নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলেও একজন ভোক্তাকেও সেদিকে তাকাতে দেখা যায়নি। সকলেই যেন বাজারের থলে ভরতে ছুটছেন দোকানে। একটু দেরি হলেই নদীর মাছটা ফুরিয়ে যাবে ভেবেই যেন তড়িঘড়ির অন্ত নেই কারো। তবে কিছু রিকশাচালক ওই সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন তুলে বললেন, যাদের জন্য মূল্য তালিকা ঝুলোনো, তাদের ওদিকে তাকানোর সময় নেই। বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফেরা প্যাসেঞ্জারের জন্য দাঁড়িয়ে আমরাই পড়ে পড়ে ওটা মুখস্ত করে ফেলেছি। কেউ কেউ বললেন, নতুন তো, তাই ওদিকে কেউ নজরই দিচ্ছে না। খাসির মাংসের মূল্য লেখা হয়েছে ৪৬০ থেকে ৪৮০ টাকা কেজি। তবে ছাগলের মাংসের মূল্য নেই। ছাগল কি বাজারে জবাই হয়? সে রুগ্ন ধাড়ি জবাই হলেও তো খাসির তকমা পেয়ে যায়। সিল মারা কর্তা কিসের বদৌলতে ধাড়ি-পাঠিসহ কিছুতেই খাসির সিল মেরে বাড়ি ফেরেন তা নিয়ে বাজারে কিছু কৌতুকও প্রচলিত রয়েছে। এক ভোক্তা এ মন্তব্য করে বললেন, ওসব উচিত কথায় আর কাজ নেই। কোন কথায় কে রেগে মেগে শেষ পর্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়তে হয় কে জানে? গরুর মাংসের মূল্য লেখা হয়েছে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। চালের মূল্য মোটা চাল ২৪ থেকে ২৬ টাকা, মাঝারি চাল ২৭ থেকে ২৮ টাকা। চিকন সরু চাল ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা। খোলা আটার মূল্য ২৫ থেকে ২৬ টাকা। খোলা ময়দা ৩২ থেকে ৩৫ টাকা। উন্নতমানের মসুরের ডাল ১০৮ থেকে ১১০ টাকা। সাধারণ মানের মসুরের ডাল ৮২ থেকে ৮৩ টাকা। উন্নতমানের মুগডাল ১১০ থেকে ১২০ টাকা। সাধারণ মুগডাল ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা কেজি। খেসারির ডাল ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা কেজি। সয়াবিন তেল বোতলজাত প্রতিলিটার ৯৮ থেকে ১০২ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল প্রতিলিটার ৮৫ থেকে ৮৮ টাকা। পামওয়েল ৬৩ থেকে ৬৫ টাকা লিটার। সুপার সয়াবিন প্রতিলিটার ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। দেশি পেঁয়াজ ২৮ থেকে ৩০ টাকা কেজি। বিদেশি পেঁয়াজের মূল্য তালিকা অবশ্য গতকাল লেখা ছিলো না। রসুনের কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। বিদেশি রসুনের মূল্য তালিকা লেখা ছিলো না। আদার মূল্য প্রতিকেজি দেশি-বিদেশি ৯০ থেকে ১১০ টাকা। চিনি দেশি প্রতিকেজি ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। বিদেশি চিনির দামও একই। কাঁচা মরিচের কেজি ১৬ থেকে ২৪ টাকা। ফার্মের ডিম প্রতি হালি ২৮ থেকে ৩০ টাকা। শাদা আলু প্রতিকেজির দাম ১৪ থেকে ১৫ টাকা। লাল আলুর প্রতিকেজি মূল্য ১৪ থেকে ১৬ টাকা। এ মূল্য তালিকা নির্ধারণ করেছে চুয়াডাঙ্গা দোকানমালিক সমিতি ও কৃষিবিপণন অধিদফতরের জেলা মার্কেটিং কার্যালয়। গতকাল এ মূল্য তালিকার সাথে বাজারে এসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর দামের অধিকাংশেরই মিল পাওয়া গেছে। মূল্য তালিকার ফলকে ২৭টি পণ্যের নাম ও মূল্য থাকলেও লেয়ার বা দেশি কোনো মুরগিই ঠাই পায়নি তাতে।
গতকাল লেখা মূল্য তালিকায় মাছের মূল্য লেখা ছিলো না। পচনশীল দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য ওভাবে লেখার রেওয়াজও নেই। যখন যেমন আমদানি, তখন চাহিদার ওপর ভর করেই ওঠানামা করে তার মূল্য। ভোক্তারা সচেতন হলে হুট করে হাটে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম আকাশচুম্বি যেমন হয় না, তেমনই কর্মকর্তাদের নজরদারি অব্যাহত থাকলে মধ্যসত্ত্বভোগীদের মূল্য হাকের গলাও অতো চড়ে না। এরকম মন্তব্য অনেকের। বোশেখ বরণের একদিন আগে গতকাল চুয়াডাঙ্গার মাছের বাজার ঘুরে ইলিশের তেমন দেখাই মেলেনি। কয়েকজন বিক্রেতা ইলিশ নিয়ে বসলেও মূল্য ছিলো চড়া। ৫শ থেকে ৬শ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতিকেজি ৮শ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বড় ইলিশের দাম সুযোগ বুঝে যেমন দাম হেকেছে টাকার গরমে আক্রান্ত ক্রেতা তেমন দরেই কিনে বাড়ি ফিরেছেন। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে বড় ইলিশ একটিও পড়ে থাকেনি মাছবাজারে। কেউ কেউ পয়লা বোশেখে পান্তা ইলিশের জন্য আগে থেকেই কিনে রেখেছেন বলে জানিয়ে একাধিক বিক্রেতা বললেন, ইলিশের যখন আকাল, তখন পান্তা-ইলিশ খেতেই হবে কেন?
জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দেশে সব কিছুতেই হাউখাউ লেগে থাকবে না তো কী হবে? এরকম প্রশ্ন তুলে মাছ বিক্রেতাদেরই একজন বললেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও যদি পেঁয়াজের দাম পাঁচপাই বাড়ে তো প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। ক্রেতাদের অধিকাংশই এক কাতারে দাঁড়িয়ে কেন বাড়লো পাঁচপাই তা প্রশ্ন তুলে জানতে চায়। মাছের বাজারে মূল্য নামক ঘোড়া লাগাম ছাড়া? তাও সহ্য করবে না কেউ। যদি ক্রেতা বা ভোক্তা সমিতির তরফে ঝুলিয়ে দেয়া হয় ‘আজ মাছ কেনা বন্ধ’। তো কেউ সে দিকে ঘুরেও তাকাবে না। জামাই এলেও না। মুরগি বা মুগডাল, লবণ বা লালশাক কোনোটির বেলাতেই সেখানে খুব বেশি ব্যাতিক্রম হওয়ার জো নেই। আছে ভোক্তা সমিতি। ভোক্তারাও সচেতন। সেরকম সমিতি কি আমাদের সমাজে হবে?
মুদিদোকানে কয়েকজন ক্রেতার সামনে এ প্রশ্ন তুলতেই তাদের মধ্য থেকে একজন বললেন, কে করবে কাকে বিশ্বাস! যাকেই বিশ্বাস করে নেতা বানাবে, সেই কোনো না কোনো দলের হয়ে সঙ্কীর্ণতায় আটকে যাবে। ভোক্তাদের স্বার্থ ভুলে দলের স্বার্থে আওড়াবে বুলি। আমরা আমজনতা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে যাবো। কাউকে ওরকম নেতা বানিয়ে রাজনীতি নামক বাণিজ্যের সওদাগর আর করছিনে। যে যেখানে আছি সে সেখানে থেকে একটু সচেতন হয়ে মূল্যবৃদ্ধি রোধে দায়িত্বশীল হলেও স্বল্প আয়ের পরিবারে মাসে অন্তত একদিন ইলিশ জুটবে।