বর্ষবরণে বাঙালির ঘরে বাইরে আগাম প্রস্তুতি : বাজারে ভিড়

ফতুয়ার আবদার মেটাতে না পেরে মা হারালেন সন্তান  

 

আলম আশরাফ: বঙ্গাব্দ গণনার ইতিহাস যাই হোক, কালক্রমে ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে বছর ঘুরে বাঙালির ঘরে বাইরে যে উৎসব হাজির হয়, তার নাম পয়লা বোশেখ। আর মাত্র একদিন পরই বাংলা নববর্ষ। বর্ষবরণে চলছে সাজসাজ রব। নতুন পোশাক কেনারও রেওয়াজ যুক্ত হয়েছে বর্ষবরণের আয়োজনে। বর্ষবরণের জন্য ফতুয়া কেনার আবাদার মেটাতে না পেরে এবার এক কিশোর ছেলেকেই হারাতে হয়েছে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা আকন্দবাড়িয়ার অসহায় এক মাকে।

পান্তা ইলিশ? ইলিশের দেশে ইলিশের আকালে বর্ষবরণের ষোলআনাই কয়েক বছর ধরেই থেকে যাচ্ছে ঘাটতি। এবার ইলিশের আকাল একটু বেশিই। সে কারণে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে ইলিশ-পান্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বপ্নের মতোই। ইলিশ জুটবে না বলে কি সন্তানের একটা নতুন ফতুয়া কেনা হবে না? মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তদের মাঝে এবারও নতুন জামা কেনার ধুম পড়েছে। প্রতিদিনই চুয়াডাঙ্গার বিপণী বিতানগুলোতে উপচেপড়া ভিড় জমছে। ক্রেতাদের অধিকাংশই নারী। এদের অভিমত, নিজের জন্য নয়, ছেলেমেয়েদের আবদার মেটাতেই বাজারে এসেছি। আগে শুধু ঈদ পুজোয় নতুন পোশাক কেনা কাটার ধুম পড়তো, এখন বর্ষবরণেও নতুন পোশাকের রেওয়াজ। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে গরমের জন্য উপযোগী ফতুয়ার দিকেই অধিকাংশ ক্রেতার ঝোঁক। এ ফতুয়ার আবাদ করেছিলো বছর পনেরোর কিশোর সাইদুর রহমান। চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের বেগমপুর ইউনিয়নের আকন্দবাড়িয়া ফার্মপাড়ার মৃত ওমর আলীর ছেলে সাইদুর রহমান তার মায়ের নিকট বলেছিলো, নববর্ষের দিনে পরার জন্য সকলেই কিনছে নতুন ফতুয়া। আমাকেও কিনে দিতে হবে। অভাবের সংসার। কয়েক বছর আগে মারা গেছেন ওমর আলী। সংসার চালাতেই হিমসিম। ফতুয়া কিনে দেবো কীভাবে? এ কথায় অভিমানী হয়ে সাইদুর রহমান গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মাঠে বসে বিষপান করে। বাড়ি ফিরলেই টের পান পরিবারের সদস্যরা। তাকে দ্রুত নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। বেলা আড়াইটার দিকে মারা যায় সে। একমাত্র ছেলে সাইদুরকে হারিয়ে কিছুতেই সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না শোকার্ত মা। বর্ষবরণের দু দিন আগেই গতরাতে নিজ গ্রামে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয় তার। সাইদুরের আত্মহত্যায় কি অন্যের বর্ষবরণ থেমে থাকবে? কারো জন্য কিছু কি কোনো দিন থেমে থেকেছে। সময় গড়ায় সময়ের হাত ধরে। শিশু-কিশোরদের ফতুয়ার দাম আড়াইশ থেকে শুরু করে সাড়ে ৫শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কিছু ফতুয়া আছে যার দাম হাজারেরও বেশি। কিশোরীদের জন্য টেপ জাতীয় জামার দামও আড়াইশ থেকে হাজারের মধ্যে। শাড়ি? শিশুদের জন্যও প্রস্তুত করা শাড়ি বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। ১২০ টাকা থেকে শুরু করে হরেক রকমের শাড়ির হরেক দাম। বড়দের শাড়ির বহর নিদিষ্ট থাকলেও দামের বহর যেন লাগাম ছাড়া।

চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে বর্ষবরণের আগাম প্রস্তুতিতে চললে জোরে সরে। এবারও চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার বিশেষ উদ্যোগে টাউন ফুটবল মাঠে বোশেখি মেলার যেমন আয়োজন করা হয়েছে, তেমনই জেলা প্রশাসনের তরফেও বিশাল শোভাযাত্রারও প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বিজিবিও বসে নেই। সীমান্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও বোশেখি মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বোশেখি মেলার প্রস্তুতি চলছে।

এদিকে জেলা প্রশাসনের অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে- ১ বোশেখ মঙ্গলবার সকাল ৬টায় চুয়াডাঙ্গা ঝিনুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বোশেখি বরণ উৎসব শুরু হবে। এরপর সকাল ৭টায় ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ থেকে বোশেখি মেলার শোভাযাত্রা বের করা হবে। শহর প্রদক্ষিণ করে সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে আলোচনাসভার পাশাপাশি বোশেখির নাচ ও গান পরিবেশন করা হবে। বেলা ১১টায় জেলা শিশু একাডেমী শিশুদের জন্য জেলা শিল্পকলা একাডেমীর মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। জেলা কারাগারে কারাবন্দিদের পরিবেশনায় এবং শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এছাড়া সরকারি, বেসরকারি অফিস ও সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ মর্যদার সাথে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। হাসপাতাল, জেলা কারগার ও সরকারি শিশু সদনে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার পরিবেশন করা হবে। ঢাকা-কোলকাতাগামী মৈত্রী ট্রেনের যাত্রীদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হবে। বোশেখি মেলার নামে অশ্লীলতা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।