স্টাফ রিপোর্টা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের (৬৮) মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শেরপুরের সোহাগপুরে ১৪৪ জনকে হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ফাঁসি কার্যকরের দ্বিতীয় ঘটনা এটি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের খবরে চানখাঁরপুল, শাহবাগসহ আশপাশ এলাকায় তাত্ক্ষণিকভাবে বের হয় খণ্ড খণ্ড আনন্দ মিছিল। চুয়াডাঙ্গা ছাত্রলীগও তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দ মিছিল বের করে।
জানা গেছে, রাত ১১-৩৫ মিনিটে পুলিশ ও ৱ্যাব সদস্যদের প্রহরায় রাতেই কামারুজ্জামানের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি তার নিজ গ্রাম শেরপুর সদর উপজেলার কুমরি মুদিপাড়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। কারাগার থেকে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি বের হওয়ার পর পুলিশ ও ৱ্যাবের তিনটি করে ছয়টি গাড়ি দিয়ে কর্ডন করে কারাগার এলাকা ত্যাগ করে এবং শেরপুরের পথে রওয়ানা হয়ে যায়। ভোরেই দাফন সম্পন্ন করার কথা ছিলো।
রাত পৌনে ১২টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী জেল গেটে সাংবাদিকদের বলেন, রাত সাড়ে ১০টায় ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। পুলিশ ও ৱ্যাব প্রহরায় লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। কারাগারের একজন ডেপুটি জেলার প্রতিনিধি হিসাবে সেখানে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করবেন। পারিবারিক সূত্র জানায়, শেরপুর সদর উপজেলার কুমরি বাজিতখিলা এতিমখানার পাশে তার লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কারাসূত্র জানায়, ফাঁসির প্রক্রিয়া শেষ করতে গতকাল সন্ধ্যা ৭টার পর ১০ জন কর্মকর্তা কারাগারে প্রবেশ করেন। এর আগে লাশ বহন করতে একটি ফ্রিজ অ্যাম্বুলেন্স ভেতরে প্রবেশ করে। আরো একটি অ্যাম্বুলেন্স কারাগারের গেটের বাইরে রাখা হয়। সন্ধ্যা ৭টায় কারাগারে প্রবেশ করেন আইজি (প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন ও অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন্স) কর্নেল মো. ফজলুল কবির, ডিআইজি (প্রিজন্স) গোলাম হায়দার। এর কিছু সময় পর প্রবেশ করেন কারা হাসপাতালের ডা. আহসান হাবীব। রাত ৮টার দিকে ফাঁসির মঞ্চে বিদ্যুত সংযোগ দিতে কারাগারে প্রবেশ করেন ইলেকট্রিশিয়ানরা। রাত পৌনে ৯টার দিকে ফাঁসির মঞ্চে অতিরিক্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়। এর আগেই কারাগারে প্রবেশ করেন ঢাকার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল মালেক মৃধা, পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মফিজউদ্দিন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, একজন ম্যাজিষ্ট্রেট, সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী ও জেলার নেছার আলম। ফাঁসির মঞ্চের পাশেই তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। লাল-সবুজ রঙের সামিয়ানা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় ফাঁসির মঞ্চ।
রাত ৮টার দিকে কারা হাসপাতালের চিকিত্সক কামারুজ্জামানের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। এরপর তিনি গোসল করেন। রাতের খাবার খান। খাবারের মেন্যুতে ছিলো ভাত, মুরগির মাংস ও ইলিশ মাছ। খাবার শেষে তিনি এশার নামাজ আদায় করেন। এশার নামাজের সাথে তিনি নফল নামাজও আদায় করেন। ফাঁসির মঞ্চের পশ্চিম ও পূর্ব দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো ছিলো ১২ জন সশস্ত্র কারারক্ষী। কারাগারের আশপাশের উঁচু বাড়ির ছাদেও ছিলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক পাহারা। কারাগারের আশপাশ ঘিরে গড়ে তোলা হয় তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়।
কারাসূত্র জানায়, রাত ১০টার দিকে কারা মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মনির হোসেন তাকে তওবা পড়ান। এ সময় মাওলানা তাকে জানান যে, আপনার আজ ফাঁসি কার্যকর করা হবে। আপনি একজন মুসলমান হিসাবে আল্লাহর কাছে কৃতকর্মের জন্য তওবা করেন। পেশ ইমামের কাছে তিনি কালেমা পড়ে তওবা করেন।
যেভাবে ফাঁসি কার্যকর করা হয়: রাত ১০-১৫ মিনিটে রাজুর নেতৃত্বে ৭ সদস্যের জল্লাদ বাহিনী কামারুজ্জামানের কনডেম সেলে যায়। জল্লাদ বাহিনী কামারুজ্জামানের দু হাত পিঠমাড়া করে বেঁধে দেয়। এরপর তার মাথা ও মুখমণ্ডলে কালো টুপি (জমটুপি) পরিয়ে দেয়। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কনডেম সেল থেকে ৭ জন জল্লাদ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কামারুজ্জামানকে হেঁটে ২০ গজ দূরে ফাঁসির মঞ্চের পাশে নিয়ে যায়। তখন রাত ১০-২৭ মিনিট। ফাঁসির মঞ্চের পাশেই চেয়ারে বসেছিলেন সব কর্মকর্তারা। কামারুজ্জামান হেঁটে মঞ্চের দিকে যান। মঞ্চে ওঠার জন্য সিঁড়ির ৩টি ধাপ অতিক্রম করে ফাঁসির পাটাতনে দাঁড়িয়ে যান। এ সময় তিনি ছটফট করছিলেন। দু পা ছোঁড়াছুঁড়ি করার চেষ্টা করার সময় জল্লাদরা তার পা দড়ি দিয়ে বেঁধে দেন।
শেষ সময়ের দৃশ্য: কনডেম সেল থেকে বের করার পর থেকে কামারুজ্জামান চিত্কার করছিলেন। বলছিলেন, আমি নির্দোষ। পৃথিবীর সবাইকে সাক্ষী রেখে বলে গেলাম আমি নির্দোষ। এরপর থেকে তিনি বারবার বলছিলেন, আমি নির্দোষ। ফাঁসির মঞ্চে ওঠানোর সকল প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর জল্লাদ প্রধান রাজু ফাঁসির লিভারের (যার সাথে দড়ি সংযুক্ত থাকে) পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী শাদা রঙের রুমাল হাতে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। রাত ১০-৩০ মিনিটে রুমালটি হাত থেকে নিচে ফেলে দেন জেল সুপার। ঠিক তখনই জল্লাদ রাজু ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেয়। কামারুজ্জামানের গলায় চেপে বসে ফাঁসির রজ্জু।
শেষ প্রক্রিয়া: ফাঁসির দড়িতে কামারুজ্জামান ১৮ মিনিট ঝুলতে থাকেন। মঞ্চের নিচের কুঠরি থেকে লাশ টেনে আনা হয়। সবার সামনে লাশ রাখা হয়। তার জমটুপি, হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে ফেলা হয়। তার ঘাড়, হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। এরপর লাশ কফিনে ভরিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয়।
উল্লেখ্য, ফাঁসি কার্যকর উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় বিকেল থেকেই নিরাপত্তা বাড়তে থাকে। নিয়োগ করা হয় বিপুলসংখ্যক ৱ্যাব, পুলিশ। লালবাগ জোনের উপপুলিশ কমিশনার ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ সন্ধ্যায় জানান, কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশে ১৫ প্লাটুন পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সেখানে ১৮০ জনের মতো ৱ্যাব সদস্য নিয়োজিত রয়েছে বলে জানায় ৱ্যাব কর্তৃপক্ষ। রাত ৮টার দিকে ৱ্যাবের একটি স্ক্যানার গাড়ি কারাগারের সামনে আসে। বোমা ও অস্ত্র চিহ্নিত করতে সক্ষম এ অত্যাধুনিক গাড়িটি কারাগারের চারপাশে ঘুরতে থাকে। কারাগারের পকেট গেটে বিকেলে আর্চওয়ে বসানো হয়। এছাড়া শাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিলো। বাড়তে থাকে উৎসুক জনতার ভিড়।