রাতে ফাঁসি হলো না

স্টাফ রিপোর্টার: সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরও শুক্রবার রাতে মানবতা বিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। শেষ সময় মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তার পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে চাওয়ায় এ রায় কার্যকর করতে পারেনি জেল কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ ফাঁসির রায় কার্যকর করা সংক্রান্ত ফাইল প্রস্তুত না হওয়ায় রাত ১০টার দিকে জানানো হয় যে, শুক্রবার রাতে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করার সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে শনিবার রাতের যেকোনো সময় তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। ফাঁসি কার্যকর করার ব্যাপারে শুক্রবার রাত ৯টা পর্যন্ত কারা কর্তৃপক্ষ মতামত দেয়নি। কারা অধিদফতরেরর একজন কর্মকর্তা বলেন, কামারুজ্জামানেরর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সিভিল সার্জনের পক্ষে একজন চিকিত্সক কারাগারে গেছেন। সব আয়োজন চূড়ান্ত করা হয়েছে। কারাগারে ৯ জন অস্ত্রধারী কারারক্ষীও প্রবেশ করানো হয়েছে। ফাঁসির মঞ্চে আশেপাশে প্রতিনিধিদের বসার জন্য চেয়ার রাখা হয়। ফাঁসির মঞ্চও প্রস্তুত। ৫ সদস্যের জল্লাদ বাহিনী মঞ্চে অবস্থান নেয়। কিন্তু শেষ সময় মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তার পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা পোষণ করায় ফাঁসির কার্যক্রম প্রক্রিয়া থেমে যায়। তিনি আরো বলেন, ফাঁসি সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি নির্দেশনা পাঠানোর কাজটিও হয়নি। এ কারণে শেষ সময় মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে শুক্রবার রাত আটটা থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও এর আশপাশে হঠাৎ করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশ-ৱ্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়। পুলিশের লালবাগ বিভাগীয় উপকমিশনার মফিজ উদ্দিন জানিয়েছেন, ওপরের নির্দেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কারণ এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কারা কর্তৃপক্ষই বলতে পারবেন। তবে রাত পৌনে আটটার দিকে কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ তাদের সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু জানায়নি।এর আগে কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি-না এ নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার সাথে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট দেখা করেন। দু ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি-না এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন না বলে দুই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জানিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি প্রাণ ভিক্ষার আবেদন না করলে শনিবার রাতের যেকোনো সময়ে ফাঁসি কার্যকর করা হতে পারে। তবে এর আগে তার পরিবারের সদস্যদের শেষ সাক্ষাৎ করতে পারবেন। এর আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আপিল বিভাগ থেকে কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে। এরপর থেকে গত ৪ দিন ধরে চলে কামারুজ্জামানের প্রাণ ভিক্ষার আবেদন আদৌ করবেন কিনা। এ নিয়ে কামারুজ্জামানের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তার আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। আইনজীবীদের সাক্ষাত করার পরও বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা ভোগেন। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা জেলার দুই ম্যাজিস্ট্রেট ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। তারা হলেন তানজিম আজিম ও মাহবুব জামিল। সাড়ে ১১টার দিকে তারা কারাগার থেকে বের হয়ে গাড়িতে করে চলে যান। কামারুজ্জামানের সাথে কী কথা হয়েছে- এ ব্যাপারে তারা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, দুজন ম্যাজিস্ট্রেট কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করেছেন। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি-না- এ নিয়ে আরো একটু ভাবার সময় চেয়েছেন। কবে ফাঁসি হতে পারে-এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, যা কিছু করা হবে তা বিধি অনুযায়ী দ্রুততার সাথে করা হবে।

যেভাবে ফাঁসি কার্যকর করা হবে: সাবেক একজন কারা কর্মকর্তা জানান, কারাগারে ফার্সির দণ্ড কার্যকর করতে আধা ঘণ্টার সময় সময় লাগে। তবে এর মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা শেষে মূল মঞ্চে সময় লাগে ১৫ থেকে ১৭ মিনিট। এ কারা কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ছিলেন ঢাকা কারাগারে কর্মরত। তিনি জানান, ফার্সির মঞ্চের কাছে (৫০ গজের মধ্যে) কনডেম সেল (আটসেল)। এখানে রয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান।

ফাঁসি কার্যকর করার ব্যাপারে তিনি অভিজ্ঞতা আলোকে বলেন, কনডেম সেল থেকেই ফাঁসির মঞ্চে দণ্ডিতকে নিয়ে আসবেন। তবে এর আগে কনডেম সেলে গোসল ও নামাজ পড়ে নিবেন দণ্ডিত ব্যক্তি। পড়ানো হবে কালেমা। এ কাজটি করবেন কারা ইমাম। এরপর জল্লাদ দণ্ডিতের দু হাত পেছনে দিকে বেঁধে ফেলবেন, পড়াবেন কালো রঙের জমটুপি। জল্লাদরা তাকে ধরে নিয়ে যাবেন ফাঁসির মঞ্চে। সিঁড়ির পাঁচটি ধাপ পেরিয়ে মঞ্চে ওঠানো হবে। মঞ্চে ওঠানোর পর যে গর্তটি কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢাকা থাকে সেখানে দাঁড় করানো হয় দণ্ডিতকে। এরপর দু পা শাদা কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়। এ কাজগুলো সম্পন্ন করার মধ্যেই ফাঁসির লিভারের (হাতল) কাছে অবস্থান নেয়া জল্লাদ প্রস্তুত হয়। জল্লাদরা ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দেয় দণ্ডিতের গলায়।

ফাঁসির মঞ্চের কাছে রাখা টেবিল সামনে রেখে মঞ্চমুখ করে চেয়ারে বসবেন সিভিল সার্জন, ঢাকা জেলা প্রশাসক, ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার, আইজি প্রিজন্স, জেল সুপার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের একজন প্রতিনিধি এবং কারা হাসপাতালের চিকিত্সক। থাকবে ৯ জন সশস্ত্র কারারক্ষী। জেল সুপারের হাতে থাকে লাল রুমাল। ওই রুমাল নামিয়ে ফেলার সাথে সাথে গিয়ারে টান দেয়া হয়। সরে যায় গর্তের কাঠ। তখনি ফাঁসির রজ্জুতে গর্তের ভেতরে ঝুলতে থাকেন দণ্ডিত। মৃত্যু নিশ্চিত করতে ১৫-১৬ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হবে। পরে মরদেহ আবার গর্ত থেকে টেনে মঞ্চে ওঠানো হয়। তারপর দড়ি খুলে মরদেহ রাখা হয় সরকার ও কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সামনে রাখা টেবিলে। তারা দেখার পর লাশ নেয়া হয় পাশের মর্গে। সেখানে লাশের স্পাইনাল কর্ড ও হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়।

তারপর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভাবে আধা ঘণ্টায় শেষ হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা। ফাঁসিতে দড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয় ম্যানিলা রোপ। আর জল্লাদ ঠিক করা হয় কয়েদীদের মধ্য থেকেই।