স্টাফ রিপোর্টার: রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না সে বিষয়ে বৃহস্পতিবারও সিদ্ধান্ত জানাননি জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তার সাথে দেখা করার পর তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত না জানানোয় আটকে আছে তার ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া।
এদিকে কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না সে বিষয়ে জানার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে যাবেন বলে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংবাদমাধ্যমকে জানান। কিন্তু রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে যাননি। একই সাথে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, বৃহস্পতিবারের মধ্যেই কামারুজ্জামানকে প্রাণভিক্ষা চাইতে হবে।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য যৌক্তিক সময়ের যে কথা বলা হচ্ছে- তা সাত দিন হতে পারে না। প্রাণভিক্ষার আবেদন লিখতে যতোটা সময় প্রয়োজন ততোখানি সময় দেয়াই যৌক্তিক বলে মনে করি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন-১৯৭৩-এর ২০(৩) অনুযায়ী এ আইনের অধীনে দণ্ডিতদের সাজা কার্যকর করবে সরকার। রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার মধ্যদিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় এখন কামারুজ্জামানের সাজা কার্যকরের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। প্রাণভিক্ষার জন্য কতোটুকু সময় তাকে দেয়া হবে তাও নির্ভর করছে সরকারের ওপর।
এদিকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত প্রভাবশালী জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ অবস্থায় সরকার তার সাজা কার্যকর নিয়ে অন্য কোনো চিন্তা-ভাবনা করছে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে কেউ কেউ। ফাঁসি কার্যকর নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। কখন ফাঁসি কার্যকর হবে- এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী বলেন, অবস্থা দেখে বোঝেন না, এ বিষয়ে বেশি কথা বলায় নিষেধ আছে!
ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত: রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের বিষয়ে কামারুজ্জামান ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবীরা। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে কারাগারে প্রবেশ করেন শিশির মুহাম্মদ মনিরসহ তার পাঁচজন আইনজীবী। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন।
কারা ফটকে শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তিনি (কামারুজ্জামান) আমাদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমরা তাকে রিভিউ খারিজ করে যে রায় দেয়া হয়েছে তা পড়ে শুনিয়েছি। তিনি আমাদের কাছে আইনগত বিভিন্ন বিধিবিধান জানতে চেয়েছেন। আমরা আইনগত দিকগুলো তুলে ধরেছি। কোন্ কোন্ বিধিবিধান তুলে ধরা হয়েছে- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে শিশির মনির বলেন, আইনগত অনেক কনফিডেনশিয়াল বিষয় থাকে। মহামান্য বিচারপতিরা যেসব আরগুমেন্ট রিজেক্ট করেছেন, এসবের ব্যাপারে আমাদের যে অবস্থান, সেগুলো আমরা মূলত তাকে বলেছি। তিনি আমাদের বলেছেন, আইনগত যেসব পদক্ষেপ আছে, এ ব্যাপারে তিনি চিন্তা-ভাবনা করবেন। এরপর তিনি জেল কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
সিদ্ধান্ত না জানানো পর্যন্ত রায় কার্যকর করা যাবে না উল্লেখ করে শিশির মনির বলেন, ভাবনা-চিন্তার জন্য একদিন, দুদিন, তিন দিনও সময় নিতে পারবেন তিনি। যতোক্ষণ পর্যন্ত না কামারুজ্জামান তার সিদ্ধান্ত জানাবেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত এ রায় কার্যকর করা অনুচিত। আইনগতভাবেও এ রায় কার্যকর করা ঠিক হবে না।
ভেবে দেখতে কত দিন সময় চেয়েছেন কামারুজ্জামান- এ প্রশ্নের জবাবে শিশির মনির বলেন, জেলকোড (কারাবিধি) অনুযায়ী রায় যেদিন হয়, এর পর থেকে আসামির সাত দিন পর্যন্ত সময় পাওয়ার কথা। গণমাধ্যমে এসেছে, তিনি ভেবে দেখার জন্য একদিন সময় চেয়েছেন। এটা ঠিক নয়।
কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে- এমন দাবি করেন তার এ আইনজীবী। তিনি বলেন, মহামান্য বিচারপতিরা আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে যে রায় দিয়েছিলেন সেখানে জেলকোড অ্যাপ্লিকেবল (প্রযোজ্য) নয়, এমন কোনো কথা লেখা নেই।
প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি–না আজকেই জানাতে হবে: কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সেটা তো আমাদের আজকেই জানাতে হবে, তিনি প্রাণভিক্ষা চান কি-না। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আদালতের রায়ের নির্দেশনা ও কারাবিধি অনুযায়ীই কারা কর্তৃপক্ষ সব পদক্ষেপ নেবে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কামারুজ্জামানের সঙ্গে কিছু সময়ের মধ্যে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট দেখা করবেন। তিনি প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। অন্যথায় রায় দ্রুত কার্যকর করবে সরকার।
সাজা কার্যকরে বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো বিলম্ব হচ্ছে না। আপনারা নিশ্চিত থাকেন, আমরা যথাযথভাবেই এটা শেষ করব। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট কিছুক্ষণের মধ্যে তার কাছে যাবেন। তিনি (কামারুজ্জামান) বলে দিলে তো হলোই। আর যদি আরও এক ঘণ্টা সময় চান তাহলে সময় দেয়া হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে আজই তাকে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে।
কামারুজ্জামান সিদ্ধান্ত জানাতে কত সময় পাবেন- জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভেবেচিন্তে বলুক আর যেভাবে বলুক, আমরা তার কথাটির জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি যদি ক্ষমাভিক্ষা না চান, তাহলে যেটা আইন অনুযায়ী করণীয় সেটা আমরা করব। প্রাণভিক্ষা না চাইলে বৃহস্পতিবারই দণ্ড কার্যকর করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আজই (বৃহস্পতিবারই) হবে কিনা তা আমি বলতে পারবো না। তবে সময়মতোই কার্যকর হবে।
শেরপুরে কামারুজ্জামানের লাশ দাফনে মুক্তিযোদ্ধাদের আপত্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেটা মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। মুক্তিযোদ্ধারা বলতেই পারেন এরকম একজন কুখ্যাত ব্যক্তির লাশ শেরপুরে দাফন হবে না। তবে দণ্ড কার্যকর করার পর আইন অনুযায়ী লাশ আমরা তার পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেবো। তার পরিবার কোথায় দাফন করবে সেটা তাদের বিষয়।
পয়লা বোশেখের আগে ফাঁসি কার্যকর হলে জামায়াত-শিবির পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে নাশকতা চালাতে পারে এ কারণে সরকারই বিলম্ব ঘটাচ্ছে- এমন এক অভিযোগের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, পয়লা বোশেখের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে ভীত নই। সময়মতোই রায় কার্যকর করা হবে।
যৌক্তিক সময় ৭ দিন নয়: ক্ষমাভিক্ষার আবেদনের সময় প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, রিজনেবল সময় যা দরকার ততোখানি, মার্সি পিটিশন লিখতে যতটা সময় প্রয়োজন হয় ততখানি। উনি যদি বলেন, মার্সি পিটিশন করবেন, এ জন্য সাত দিন সময় দিতে হবে- এটা তো রিজনেবল হবে না।
ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ ধারার উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমার বিবেচনায়, আমার অভিমত… সরকারের নির্দেশনায় এ দণ্ড কার্যকর করা হবে। ফৌজদারি মামলায় ফাঁসির রায়ের আগে প্রাণভিক্ষার এ আনুষ্ঠানিকতার জন্য ৭ থেকে ২১ দিনের সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না বলে আগেই জানিয়েছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবারও তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইন অন্য আইনের মতো না। … যেহেতু এ বিশেষ আইনের ভেতরেই উল্লেখ করা আছে, সরকারের নির্দেশে সাজা কার্যকর হবে এবং এ কথাও আইনে বলা আছে, অন্য আইনে যাই বলা থাক না কেন এ আইনের বিধানই প্রাধান্য পাবে।
ম্যাজিস্ট্রেট যাননি: নিয়ম অনুযায়ী কামারুজ্জামান দায় স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা তা জানার জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কারাগারে যাওয়ার কথা। কিন্তু রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো ম্যাজিস্ট্রেট কারাগারে যাননি। সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী অফিস থেকে চলে যান।
রক্ষীদের সাথে দুর্ব্যবহার: কারা সূত্র জানায়, বুধবারের তুলনায় বৃহস্পতিবার অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক ছিলেন কামারুজ্জামান। সকালের নাস্তায় তিনি রুটি, গুড় ও ডাল খেয়েছেন। দুপুরে খেয়েছেন মুরগির মাংস, সবজি ও ভাত। রাতের খাবারও খেয়েছেন। আইনজীবীরা তার সাথে সাক্ষাৎ করে আসার পর কারারক্ষীরা দুপুরের খাবার নিয়ে গেলে তিনি তাদের সাথে রূঢ় আচরণ করেন। তবে তিনি আগের দিনের চাইতে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক ছিলেন বলে কনডেম সেলের কাছে দায়িত্ব পালনকারী একজন কারারক্ষী জানিয়েছেন।
ফাঁসির মঞ্চ থেকে মাত্র ১২ গজ দূরত্বে: ফাঁসির মঞ্চ থেকে কামারুজ্জামানের কনডেম সেলের দূরত্ব মাত্র ১২ গজ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৬ নম্বর কনডেম সেলে বন্দি আছেন তিনি। এর ঠিক উত্তর পাশে আনুমানিক ১২ গজ দূরে রয়েছে দুটি ফাঁসির মঞ্চ। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, পুরোনো মঞ্চটিতেই কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। তিনজন কারারক্ষী পালা করে মঞ্চটি পাহারা দিচ্ছেন। সাথে আছেন কয়েকজন বিশ্বস্ত কয়েদী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদেরই একজন জানান, ফাঁসির মঞ্চটি পুরোপুরি প্রস্তুত। এ মঞ্চেই অপর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিলো।
কারাগারের সামনের চিত্র: রায় কার্যকর করা উপলক্ষে নাজিম উদ্দিন রোডে মিডিয়াকর্মীদের ভিড় জমে রয়েছে। প্রায় সবকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সেখান থেকে প্রতিটি বুলেটিনে লাইভ সংবাদ সম্প্রচার করছে। টেলিভিশনের গাড়ির জট লেগে গেছে নাজিম উদ্দিন রোড এলাকায়। এছাড়া বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইনের সাংবাদিকরাও দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের সঙ্গে ভিড় জমিয়ে রেখেছেন উৎসুক মানুষজনও। তবে দণ্ড কার্যকর করার জন্য যেসব ব্যক্তি ও সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতি প্রয়োজন তাদের কাউকে দেখা যায়নি বৃহস্পতিবার। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রেখেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনাল এ জামায়াত নেতাকে ফাঁসির দণ্ড দিয়ে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করলে গত বছরের ৩ নভেম্বর সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে তার ফাঁসি বহাল রাখা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। পরদিন ট্রাইব্যুনাল-২ তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠালে সেখানে কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ৫ মার্চ আবেদন করেন কামারুজ্জামান। এরপর মৃত্যুপরোয়ানার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যায়। ৫ এপ্রিল এই রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ৬ এপ্রিল রিভিউ খারিজ হয়ে যায়। আর এর মধ্যদিয়ে বিচার প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে ৬২ বছর বয়সী এ যুদ্ধাপরাধীর।