যেকোনো সময় ফাঁসি : প্রস্তুত পাঁচ জল্লাদ

প্রাণ ভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য আইনজীবীর সাথে সাক্ষাৎ আজ

 

স্টাফ রিপোর্টার: যেকোনো সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে। গতকাল সন্ধ্যায় ফাঁসির রায়ের কপি ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছেছে। পাঁচজন জল্লাদকেও প্রস্তুত রাখা হযেছে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী বলেন, ট্রাইব্যুনাল পাঠানো রায়ের কপি কারা কর্তৃপক্ষ গ্রহণ (রিসিভ) করেছে। রায়ের কপি পাওয়ার পর আসামিকে তা পড়ে শোনানো হয়েছে। আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন কি-না এ জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। কারা অধিদফতরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, রায়ের কপি পাওয়ার পর কারাগারের ৮ নম্বর সেলে বন্দী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়। এরপর কামারুজ্জামানের কাছে তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি-না জানতে চায় কারা কর্তৃপক্ষ। প্রত্যুত্তরে কামারুজ্জামান বলেন যে, এর জন্য কোনো সময় আছে কি-না। নাকি এখনই জানাতে হবে। যদি সময় থাকে তাহলে তিনি আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাবেন।

গতকাল বুধবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় কামারুজ্জামানের সাথে তার আইনজীবীদের সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছে। এ অনুমতির কারণে গতকাল বুধবার কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে পারেনি কারা কর্তৃপক্ষ। কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির মো. মনির বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে আজ সকাল ১১টায় কামারুজ্জামানের সাথে সাক্ষাতের জন্য ডেকেছেন। কামারুজ্জামানের আইনজীবী প্যানেলে অন্য সদস্যরা হলেন- মশিউল আলম, এহসান এ সিদ্দিকি, মতিউর রহমান আকন্দ ও মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নেছার আলী সাংবাদিকদের বলেন, রায়ের কপি পাওয়ার পর মার্সি পিটিশন (প্রাণভিক্ষার আবেদন) কামারুজ্জামানকে দেয়া হয়েছে। কামারুজ্জামান যদি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা (মার্সি পিটিশন) চান তাহলে তিনি তাতে স্বাক্ষর করবেন। আর না করলে তিনি তা অবহিত করবেন। গতকাল বুধবার রাত ৮টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলসুপার ফরমান আলী কারা অধিদফতরের আইজি (প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিনের সাথে দেখা করেন। এর আগে গতকাল বুধবার দুপুরে ৩৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন প্রধান বিচারপতিসহ চার বিচারপতি। বুধবার সন্ধ্যা ৫টা ৫০ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আফতাবুজ্জামান রায়ের কপিটি কারাগারে নিয়ে যান। সেখানে তিনি সিনিয়র জেলসুপার ফরমান আলীর কাছে রায়ের কপিটি প্রদান করেন।

অন্যদিকে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গতকাল বুধবার দুপুরে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনায় বলা হয়, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ প্রদত্ত রায়টি আজই (বুধবার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যায়। ওই রায়ে আসামি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত (এর আগের) রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এমতাবস্থায় কারাবিধি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩’র ২০(৩) উপধারা অনুযায়ী উক্ত মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার ক্ষমতা সরকারকে দিয়েছে। সেহেতু উক্ত দণ্ডাদেশ কার্যকরকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, আদালতের নির্দেশ অনুসারে ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখন কারা কর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশ অনুসারে তাদের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। এর আগে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার মুস্তাফিজুর রহমান মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে কারা অধিদফতরের আইজি (প্রিজন্স), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জেলা ম্যাজিস্ট্র্রেটের কাছে পাঠান।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই জামায়াতের এ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। এদিকে সকালে রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরপরই পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সন্ধ্যায় কারাগারের সামনের রাস্তায় যান চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে রাত ৮টার দিকে যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

প্রস্তুত পাঁচ জল্লাদ: মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করতে প্রস্তুত পাঁচ জল্লাদ। জল্লাদ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজু ও জনি। ইতোমধ্যে এ পাঁচ জল্লাদ দিয়ে ফাঁসির মহড়া দেয়া হয়েছে। ফাঁসির দড়িতে ৮০ কেজি ওজনের বালির বস্তা ঝুলিয়ে পরীক্ষাও করা হয়েছে। তবে এদের মধ্যে একজন জল্লাদই ফাঁসির মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টান দিয়ে কার্যকর করবেন।

কারাগারসূত্র জানায়, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় রাজু অথবা জনিকে ফাঁসির মঞ্চের পাশে রাখা হবে। ফাঁসির মঞ্চের পাশে অন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক। তার হাতে থাকবে একটি লাল রুমাল। হাত থেকে রুমালটি মাটিতে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে জল্লাদ মঞ্চের লিভার টেনে দেবেন। এতে আসামির পায়ের তলা থেকে কাঠ সরে ফাঁসি কার্যকর হয়।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে ধোয়া-মোছার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় রাজু ও জনির নেতৃত্বে ৯ সদস্যের জল্লাদ বাহিনীকে ডাকা হয়েছিলো। তাদের নিয়ে মঞ্চে হয়েছে ফাঁসির মহড়াও। তবে কোন জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভার টান দিবেন- কারা কর্তৃপক্ষ এখনও সেই নাম প্রকাশ করেনি। মহড়ায় অংশ নেয়া জল্লাদের তালিকা ইতোমধ্যে ছোট হয়ে এসেছে। কারা সূত্র জানায়, এখন পাঁচ সদস্যের জল্লাদ বাহিনী প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পল্টু, এরশাদ ও সাত্তার ছাড়াও আলমগীর ও রানা নামে আরো দু জল্লাদকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

রাজু ও জনি একাধিক মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া আসামি। এর মধ্যে রাজুর ১৫ বছর সাজা ভোগ শেষ হয়েছে। ২০১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসি দেয়ার সময়েও জল্লাদ প্যানেলে তাদের নাম ছিলো। তবে অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকা শাহজাহানই শেষ দায়িত্বটি পালন করেছিলেন।

কামারুজ্জামানের শেষ দু ইচ্ছা: মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান তার শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় কারাগারে রায় পড়িয়ে শোনার পর তিনি এ শেষ ইচ্ছার কথা জানান। তিনি জানান, শুক্রবার যেন তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আর ফাঁসি দেয়ার পর তার লাশের গোসল না করিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

কারাসূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রচলিত বিধান অনুযায়ী শুক্রবার কোন ফাঁসি কার্যকর করা হয় না। জুম্মার দিনের কারণে এখন পর্যন্ত এদিনে কোনো ফাঁসি কার্যকর হয়নি। অন্যদিকে কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী লাশের গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরানো হয়। এরপর কফিনে ভরে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ নিয়মটিও অতীতে সকল ফাঁসির ক্ষেত্রে রক্ষা করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিলো বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে। ফাঁসি কার্যকর করার পর লাশ গোসল করিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে কারা কর্তৃপক্ষ।

কামারুজ্জামান আইনজীবীদের নিকট যা জানতে চাইতে পারেন: জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার যতোগুলো আইনি প্রক্রিয়া ছিলো সবই শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার প্রক্রিয়াটি বাকি রয়েছে। আর এ প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বা মতামত জানাতে তিনি তার আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় তার আইনজীবীরা তার সাথে সাক্ষাতের কথা রয়েছে। যা জেল কর্তৃপক্ষ ও আইনজীবীদের সূত্রে জানা গেছে। তবে কামারুজ্জামানের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে মতামত দেয়া ছাড়াও তিনি আইনজীবীদের নিকট কিছু বিষয় জানতে চাইবেন।

কামারুজ্জামানের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, কামারুজ্জামানের আশা ছিলো আদালত তার রিভিউ আবেদনটি গ্রহণ করবেন এবং তার আইনজীবীরা মামলার ত্রুটিগুলো তুলে ধরবেন। কামারুজ্জামান মনে করেন যে, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রিভিউ শুনানি হলে তিনি এ অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস পাবেন। এখন কী কারণে তার রিভিউ আবেদনটি গ্রহণ হয়নি সেটা তিনি জানতে চাইবেন আইনজীবীদের নিকট থেকে।

সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন না একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। বরং বিচারিক প্রক্রিয়া ও রায়ের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লিখবেন তিনি। গতকাল বুধবার কামারুজ্জামানের পরিবারের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে কবরস্থান তৈরির কাজ চলছে শেরপুরের বাজিতখিলা এলাকার কামারুজ্জামানের নিজ গ্রাম মুদিপাড়ায়। গ্রামে তার প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার পাশেই মাটি ফেলে কবরস্থান তৈরি করা হচ্ছে।

যে কারণে রিভিউ খারিজ: একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে আলবদর কমান্ডার মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও তার দোসরদের মানবতাবিরোধী অপরাধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারকেও হার মানিয়েছিলো। তাদের অত্যাচার তখন বিশ্ব বিবেককে প্রকম্পিত করেছিলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা প্রাণ হারিয়েছে, শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হননি, গোটা জাতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কামারুজ্জামানের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ করে গত সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের চার বিচারপতির দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ কথা বলা হয়েছে। গতকাল বুধবার ৩৬ পৃষ্ঠার এ রায়ে স্বাক্ষর করেন চার বিচারপতি। রায়ে কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজের বিষয়ে বলা হয়, সাধারণত রিভিউ আবেদন দায়ের করা হয় ভুলভ্রান্তি দেখার জন্য। তবে আমরা আমাদের এ রায়ে কোনো ভুলভ্রান্তি আবিষ্কার করতে পারিনি।