স্টাফ রিপোর্টার: জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সব ধরনের আইনি লড়াই শেষ। আপিল বিভাগ তার রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সোমবার খারিজ করে দিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন। এখন কামারুজ্জামান একমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন। যদি তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন না করেন তাহলে যেকোনো দিন তাঁর ফাঁসি কার্যকর হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকরের সময় নির্ধারণের এখতিয়ার সম্পূর্ণ সরকারের। এদিকে সরকারের চাওয়া অনুযায়ী জেল কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু গতকাল রাত পর্যন্ত আপিল বিভাগের রায়ের কপি কারাগারে পৌঁছেনি। রায়ের কপি কারাগারে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
এরপর ৫ মার্চ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন দায়ের করেন কামারুজ্জামান। আসামিপক্ষের আবেদনে দু দফা সময় পেছানোর পর গত রবিবার আপিল বিভাগে শুনানি শেষ হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ রায়ে এ আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
আপিল বিভাগের রিভিউ আবেদন খারিজের রায় লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে। সূত্র জানায়, রাত ৯টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত তিনি রায় লিখছিলেন। এটি চূড়ান্ত হওয়ার পর আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের স্বাক্ষরের জন্য রায়টি যাবে। সকল বিচারকের স্বাক্ষরের পর সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার রায়ের কপি কারাগারে পাঠাবেন।
কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা এখন সময়ের ব্যাপার। মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেতে হলে তাকে একমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে হবে। রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করলে তবেই মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাবেন তিনি। যদি তিনি প্রাণভিক্ষা না চান বা রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে তার স্বজনদের দেখা করার সুযোগ দেয়া হবে। এরপরই ফাঁসি কার্যকর করা হবে। তবে সেটা হবে সরকারের আদেশে।
অন্যদিকে কামারুজ্জামানের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ক্ষমা চাওয়ার বিধান সব সময়ই ছিলো, সংবিধানেও আছে। তবে কামারুজ্জামান এ সুযোগ নেবেন কি-না সেই সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তার সাথে পরামর্শ ছাড়া বলতে পারছি না। তবে তিনি আগে জানিয়েছিলেন রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তির পরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করার আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। আইনজীবী শিশির মনির বেলা ১১টার দিকে ওই আবেদন নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। তারা পাঁচজন আইনজীবী বিকেল ৪টায় কারাগারে কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করার অনুমতি চান। তবে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেয়নি। এদিকে কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর তার পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ করতে ডেকে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। এরপর সন্ধ্যায় পরিবারের ১১ জন সদস্য কারাগারে গিয়ে কামারুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
সরকারের সিদ্ধান্তে হবে ফাঁসি কার্যকর: জেল কোডের ৯৯১’র বিধান অনুযায়ী প্রাণভিক্ষার জন্য সাত দিনের সময় পাবেন কামারুজ্জামান। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাণভিক্ষার জন্য নির্ধারিত সাত দিনের আগে ফাঁসি কার্যকর করা যাবে না। তবে প্রাণভিক্ষা না চাইলে দণ্ড কার্যকরে সাতদিনের অপেক্ষার প্রয়োজন হবে না।
প্রচলিত আইনে ফৌজদারি কার্যবিধি ও জেল কোডের বিধান অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জেল কোডের বিধান অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের রায়ের কপি পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার জন্য আসামিকে সাত দিনের সময় দেয়া হয়। এ সাতদিন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি যদি ফাঁসি কার্যকরের ওপর স্থগিতাদেশ বা দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস না করেন তাহলে কারা কর্তৃপক্ষকে ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হয়। কিন্তু প্রচলিত ফৌজদারি আইন ও জেল কোডের বিধান যুদ্ধাপরাধের দণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
কেননা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ একটি বিশেষ আইন। প্রয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণ আইনের চেয়ে বিশেষ আইন প্রাধান্য পাবে। ওই আইনের ২০(৩) ধারায় বলা আছে, এ আইনের অধীন প্রদত্ত দণ্ড কার্যকর হবে সরকারের আদেশাবলী অনুযায়ী। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন যে দিনই নাকচ করবেন সেদিন থেকে যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউর রায়ে আপিল বিভাগ জানান, যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন।
এ প্রসঙ্গে রায়ে বলা হয়, আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের প্রেক্ষিতে মৃত্যুপরোয়ানা জারির আদেশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছুলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের সুযোগ দেবে। একই সাথে তাকে পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করার সুযোগ দিতে হবে। যদি কোনো রিভিউ অথবা প্রাণ ভিক্ষার আবেদন দায়ের করা হয় ওই আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে না।
যে অপরাধে কামারুজ্জামানের ফাঁসি: ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে শেরপুরের সোহাগপুরে ১৬৪ জন নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা ও নারী ধর্ষণ এবং গোলাম মোস্তফা নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেন কামারুজ্জামান।
গত বছরের নভেম্বরে আপিল বিভাগের দেয়া চূড়ান্ত রায়ে আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হয়। গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দণ্ড কমিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সোহাগপুর হত্যাকাণ্ডে ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
এ অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই আলবদর ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং নারীদের ধর্ষণ করে। সেদিন ওই গ্রামে রাজাকাররা ১৬৪ জনকে হত্যা করে। ওই ঘটনার দিন থেকে সোহাগপুর গ্রাম বিধবাপল্লি নামে পরিচিত।