আলমডাঙ্গার শিয়ালমারীতে কুলখানির বৈঠক শেষে বিচার চেয়ে মিছিল : অনেকেরই অভিমত পরিকল্পিত হত্যা
ঘটনাস্থল থেকে ফিরে স্টাফ রিপোর্টার: পানবরজে নয়, রিন্টুর সাথে হানের অজ্ঞাত স্থানে কোপাকুপির পর রিন্টুই ঘাড়ে করে তার বাড়ির পাশে নেয় রক্তাক্ত হানকে। সেখানে রেখে গ্রামবাসীকে জাগিয়ে তুলে বলে, পানচোর ধরেছি। শুরু হয় পিটুনি। শুধু পিটুনি নয়, ধারালো অস্ত্রের কোপে হানের গোপনাঙ্গও ক্ষতবিক্ষত হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে মারা যায়।
যে রিন্টুর সাথে হানের কয়েক মাস ধরে খুব ঘনিষ্ঠতা, সেই রিন্টুই কেন হানকে পানচোর বলে অভিযুক্ত করে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর সামনে ঠেলে দিচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাব না খুঁজে ইউপি মেম্বারসহ কয়েকজন মাতবরের উপস্থিতিতেই নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয় হানকে। গতকাল সরেজমিনে গেলে এলাকার সাধারণ মানুষ এসব তথ্য দিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়। গতকাল সন্ধ্যায় শিয়ালমারী গ্রামের সাধারণ মানুষ বৈঠকে মিলিত হয়ে হানের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া মাহফিলের উদ্যোগ নেয়। বৈঠক শেষে বিক্ষোভ মিছিল করে হান হত্যার বিচার দাবি করে তারা।
হানের স্ত্রী বেদানা খাতুন বাদী হয়ে মামলা করেছেন। তিনি বলেছেন, ৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছি। আলমডাঙ্গা থানায় দায়ের করা মামলায় যাদেরকে সরাসরি আসামি করে মামলা করেছি, তাদের মধ্যে রয়েছে- বটিয়াপাড়ার পচা বিশ্বাসের ছেলে রিন্টু বিশ্বাস, শামসুদ্দিনের ছেলে শফিকুল ইসলাম, হায়বাত উল্লাহর ছেলে ইল্লা জোয়ার্দ্দার ও খাদিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নং ওয়ার্ড মেম্বার মিরাজুল হক বুডিয়ার। গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আসামিদের তেমন কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ। রিন্টু বিশ্বাস ঘটনার রাতেই চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরে অবশ্য হাসপাতাল ছেড়ে অজ্ঞাত স্থানে চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানা গেছে। যদিও তার নিকটজনদের একজন বলেছেন, আহত রিন্টুকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে স্থানীয়দের অধিকাংশেরই অভিমত, রিন্টুকে ধরে ঠিকমতো জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। গ্রেফতার এড়াতে বটিয়াপাড়ার অনেকেই আত্মগোপন করেছে।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাদিমপুর ইউনিয়নের শিয়ালমারী ও বটিয়াপাড়া গ্রাম দুটি পাশাপাশি। এক সময় গ্রাম দুটির মধ্যে কিছুটা দূরত্ব থাকলেও কালক্রমে গ্রাম দুটি ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দুটি গ্রামের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়াই দুরূহ। শিয়ালমারী মাঝেরপাড়ার মৃত টগর আলীর ছেলে আমির হামজা ওরফে হান্নান ওরফে হান (৪৬) দরিদ্র। একেক সময় একেক ধরনের কাজ করতো। পান-বিড়ি-চা দোকানে ফেরি করে জর্দ্দাসহ অনুসাঙ্গিক দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহের ব্যবসা করতো বলেই অনেকে জানতেন। হাতেনাতে কখনো ধরা না পড়লেও নিজ গ্রামে কয়েকটি চুরির ঘটনায় তাকে সন্দেহ করে সালিসে ডেকে সতর্ক করা হয়। গ্রামের সাধারণ মানুষ এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, বেশ কিছুদিন ধরে ফেনসিডিল পাচারের জোন বয় বলে শোনা যেতো। এ নিয়েও সালিস করে মাদক পাচারের সাথে সংশ্লিষ্টতা পরিবহারের পরামর্শ দেন মাতবররা। এছাড়া তেমন অভিযোগ নেই। হানের স্ত্রী বেদানা খাতুনও বলেছেন, মাঝে মাঝে ওরকম অভিযোগ উঠলেও কখনো তেমন কিছু দেখিনি। ৪ কন্যার জনক ছিলো হান। বড় দু মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট দু মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে, অপর মেয়ে প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। অপরদিকে পার্শ্ববর্তী বটিয়াপাড়া গ্রামের রিন্টু বিশ্বাসের দুটি পানবরজ রয়েছে। তার গ্রামের প্রবীণদের কয়েকজন অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, ওই রিন্টুকে নিয়েও এক সময় গ্রামে পানচুরির বিষয়ে সালিস হয়েছে। নিজের মামারই পানবরজ থেকে পান চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ায় বিষয়টি সালিস পর্যন্ত গড়ায়। গ্রামের অনেকেই বলেছে, ঘটনার রাত তথা গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রিন্টুরই এক ভাইয়ের দোকানে রিন্টু ও হান বসে কথা বলেছে। কয়েক মাস ধরে রিন্টুর সাথে হানের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই রিন্টুই শুক্রবার দিনগত মধ্যরাতে হানকে রক্তাক্ত অবস্থায় তার বাড়ির পাশে নিয়ে ফেলে রেখে প্রতিবেশীদের ডেকে তোলে। বলে পানচোর ধরেছি। এ সময় রিন্টুর হাতে ধারালো অস্ত্রের কোপে ক্ষত ছিলো। রক্ত ঝরছিলো। রিন্টুই জানায়, পান চুরির সময় ধরতে গেলে হান তার হাতে কোপ মেরেছে। পাল্টা কোপে হানও জখম হয়েছে।
বটিয়াপাড়ার অধিকাংশ কৃষকই পানচাষি। দীর্ঘদিন ধরেই পানবরজ থেকে পান চুরির কারণে পানচাষিদের মধ্যে পুঞ্জিভূত হয় ক্ষোভ। পূর্ব থেকেই ক্ষুব্ধগ্রামবাসী যখনই শুনেছে পানচোর ধরা পড়েছে, তখনই তাদের অনেকেই অতি উৎসাহী হয়ে পিটুনি শুরু করে। জনপ্রতিনিধিসহ মাতবরদের কেউ কেউ ঘটনাস্থলে হাজির হন। খবর পেয়ে হানের স্ত্রীও ওই রাতে বটিয়াপাড়ায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে স্বামীকে বাঁচানোর আকুতি জানান। মেম্বার মিরাজুল ইসলাম বুডিয়ারই হানের স্ত্রী বেদানা খাতুনকে সেখান থেকে ফিরিয়ে দেন। স্বামী হারানো শোকে কাতর বেদানা খাতুনের এ অভিযোগ অবশ্য বুডিয়ার মেম্বার অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, আমি বলেছিলাম, তোমাদের গ্রামের লোকজন নিয়ে এনে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। তার আগেই যে হান মারা যাবে তা বুঝিনি।
আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মামুন অর রশিদের সাথে গতরাতে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, যে ৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে তাদের গ্রেফতারের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তদন্তও অব্যাহত রয়েছে।