রবীন্দ্রনাথ সাহার প্রয়াণ

মো. আফিল উদ্দিন

 

সমবয়সীরা একে একে চলে যাচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে। এরই মাঝে আরেকটি দুঃসংবাদের সংযোজন। অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ সাহা গত ২৯ মার্চ বাগেরহাটে মারা গেছেন। চিরতরে চলে গেলেন ইংরেজি ভাষার এক অনন্য সাধারণ শিক্ষক। চলে গেলেন একাধিক মূল্যবান গ্রন্থের প্রণেতা। আর আলমডাঙ্গা হারালো তার এক কৃতীসন্তান। রবীন্দ্রনাথ সাহা আলমডাঙ্গাবাসীর নিকট রবি বাবু বলেই পরিচিত ছিলেন। এ সংক্ষিপ্ত আকারের নামটি বোধ হয় তারও পছন্দ ছিলো। কেননা তার রচিত প্রতিটি গ্রন্থেই তিনি তার নাম লেখেছেন রবি সাহা। রবি সাহার বাড়ি আলমডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী কুমারী গ্রামে। দারিদ্র্যের সাথে সংগ্রাম করে লেখাপড়া করেছেন। তার অসাধারণ মেধার কাছে দারিদ্র্য হার মেনেছে। ১৯৫৯ সালে আলমডাঙ্গা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় (বর্তমান নাম আলমডাঙ্গা বহুমুখি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়) থেকে অঙ্কে লেটারসহ ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সে যুগে পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে লেটার নম্বর পাওয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিলো। আর রবি সাহা এ দুঃসাধ্য কাজটি করতে পেরেছিলেন। কৃতিত্বের সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ এবং বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তার জীবন শুরু, শিক্ষকতা দিয়েই তার জীবন শেষ। আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, মুন্সিগঞ্জ একাডেমীতে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর আলমডাঙ্গা কলেজে ইংরেজি প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে বরিশাল রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তারপর একে একে কুষ্টিয়া, পিসি কলেজ, বাগেরহাট, ভিক্টোরিয়া, নড়াইল, বরগুনা এবং পিরোজপুর সরকারি কলেজে কৃতিত্বের সাথে অধ্যাপনা শেষে ২০০১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ইংরেজি ভাষায় অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বাংলা সাহিত্যেও সৃজনশীল অবদান রেখেছেন। রচনা করেছেন অধরা মাধুরী (গল্প সংগ্রহ), পরশমণি (উপন্যাস), বেলা-অবেলায় (উপন্যাস) এবং উলুখাগড়ার মতো কাব্যগ্রন্থ। বেলা-অবেলার প্রকাশকাল ২০১৪।

অবসরকালীন সময়ে তিনি বাগেরহাটের নিজস্ব বাড়িতে আলমডাঙ্গা কলেজ ত্যাগের ৩৮ বছর পর এ পুস্তকটি রচনা করেন। কিন্তু দীর্ঘ পরিসরেও আলমডাঙ্গাকে ভোলেননি। ভোলেননি আলমডাঙ্গা কলেজকে। বেলা-অবেলা গ্রন্থে তিনি আলমডাঙ্গা কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নের যে নিখুঁত প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন, তা নিম্নে হুবহু উদ্ধৃত করলাম। ‘এ কলেজ শুরু হয়েছিলো শহরের মাঝখানে। এক ধনী মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী বাবু গঙ্গাধর জালান শহরের কেন্দ্রস্থলে শহরের প্রধান রাস্তাটির পাশে একটি উঁচু চারতলা ভবন তৈরি করিয়েছিলেন। এটাকে তৎকালীন ওই শহরের মনুমেন্ট বলা হতো। ভবনটি ওই ভদ্রলোক ব্যবহার করতেন না। নিচতলায় একটি বড় সোনার দোকান ছিলো। আর সবতলা ফাঁকা পড়ে থাকায় কলেজটি সেই চারতলা ভবনে শুরু হয়েছিলো। সেটা ১৯৬৫ সাল। ১৭ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো কলেজ। প্রথম অধ্যক্ষ হলেন আবু তাহের। শহরের একজন খ্যাতিমান মানুষ। তিনি অবশ্য শিগগিরই বড় সরকারি চাকরি নিয়ে চলে গেলেন কলেজ ছেড়ে। কিছুদিন পরে শহরের এক প্রান্তে আলমডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের কৃষিখামার হিসেবে ব্যবহৃত ৮-১০ বিঘা জমির ওপর একটি প্লটের সন্ধান পেয়ে শহরের বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি কলেজটি স্থানান্তরিত করলেন।

রবীন্দ্রনাথ সাহার সাথে আমার শেষ মোবাইলফোনে কথপোকথন হয় গত বছর মে মাসের দিকে। তিনি আলমডাঙ্গা স্কুলের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিতব্য সুভেনির জন্য ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’ শীর্ষক একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা পাঠান। এ লেখাটির ওপর কথাবার্তা শেষে পারস্পরিক কুশলাদি বিনিময় হয়। দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্নের পর যে খবরটি এলো, সেটা সুখবর নয়; মৃত্যু খবর। রবীন্দ্রনাথ সাহার সেই শিশুসুলভ সরলতার চিহ্নবিশিষ্ট মুখ আর মৃদু হাস্যময় কথার স্মৃতি কতোদিন ধরে রাখতে পারবো তা জানি না। তবু তার পাঠানো স্মৃতিচারণমূলকের শিরোনামটি পুনরাবৃত্তি করে আমিও বলি- ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।’

(লেখক: প্রাক্তন শিক্ষক, আলমডাঙ্গা বহুমুখি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়)।