গণ্ডগোলের মূলে যুক্তরাষ্ট্র

……………. সাইফুল সামিন ……………….

 

দৃশ্যগুলো যেন সাজানো নাটকের মতো। নেপথ্যে থাকা পরিচালকের ইশারায় চলে সবকিছু। নাট্যমঞ্চ মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে একের পর এক চলছে নানা নাটকের মহড়া। এবার মঞ্চের মধ্যমণি ইয়েমেন। দর্শকদের নজর দেশটির নতুন সঙ্কটের দিকে। ইয়েমেনে নাটকীয় এক যুদ্ধের আকস্মিকতায় সবাই বিস্মিত। এমন নাটক মঞ্চস্থ করার কৃতিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের। পর্দার অন্তরালে বসে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে গণ্ডগোল জিইয়ে রাখতে কলকাঠি নাড়ছে।

একটা সময় মধ্যপ্রাচ্যসঙ্কট বলতে কেবল ফিলিস্তিন প্রসঙ্গটিই বোঝাত। সে সঙ্কটকে জিইয়ে রাখার ক্রীড়নকও এ যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু শুধু ফিলিস্তিন নিয়ে পড়ে থেকে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মিটছিলো না। তাই মিথ্যা অজুহাতে ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয়। ইরাকের বারোটা বাজিয়ে সেখান থেকে লেজগুটিয়ে পালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর তার বদনজর পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে। চার বছর আগে মার্কিন-সমর্থিত কথিত আরব বসন্তের নামে অঞ্চলটির বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে গণ অসন্তোষ। বিক্ষোভে উত্তাল হয় তিউনিসিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া, মিসর, ইয়েমেন, লেবানন, বাহরাইন, আলজেরিয়া, জর্ডান, ওমান, সুদান, কুয়েত, মরক্কো প্রভৃতি দেশ। আরব বসন্তে তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মিসর ও ইয়েমেনে সরকার পর্যন্ত পড়ে যায়। এরপর দেশগুলোতে আসে নতুন সরকার। কিন্তু স্বপ্নের গণতন্ত্র ও শান্তি অধরায় রয়ে যায়। বরং সিরিয়া, লিবিয়া, মিসর ও ইয়েমেনের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সঙ্কটের কেন্দ্রে একেক সময় একেক দেশের নাম চলে আসে। এবারের পালা ইয়েমেনের। গত ২৬ মার্চ ইয়েমেনে শিয়াপন্থি হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে আরব দেশগুলোর জোটবাহিনী। এ পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক যুদ্ধের সূচনা হয়েছে।
এ আর কিছুই নয়, মূলত দু আঞ্চলিক শক্তি সুন্নিপ্রধান সৌদি আরব ও শিয়াপ্রধান ইরানের ছায়া রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ইয়েমেন। আরব বিশ্বের অন্যতম গরিব দেশ ইয়েমেন। প্রতিবেশী দেশটি নাক গলানো সৌদি আরবের পুরোনো অভ্যাস। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ইয়েমেনকে নিজের কবজায় রাখতে তৎপর রিয়াদ। তাই বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ইয়েমেনকে সৌদি আরবের পেছনের আঙিনা বলে টিপ্পনি কাটতে ছাড়ে না।

ইয়েমেনের ওপর সৌদি আরবের ছড়ি ঘোরানো সম্প্রতি কঠিন হয়ে উঠেছিলো। বিশেষ করে দুটি ঘটনায় গত এক দশকে ইয়েমেনে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। এ সময়ে দেশটিতে আল-কায়েদা ইন দি অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলার (একিউএপি) উত্থান ঘটে। জঙ্গি গোষ্ঠীটি ইয়েমেনে জাতিগত ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে ইরানের মদদপুষ্ট হুতিরা ইয়েমেনে ব্যাপক শক্তি সঞ্চার করে ক্ষমতার দাবিদার হয়ে উঠেছে।

ইয়েমেনে ২০১১ সালে গণবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ। তার পতনের পর দেশটির ক্ষমতায় আসে আবদুরাব্বাহ মনসুর আল হাদির সরকার। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া জোরদারের দাবি পূরণ না হওয়ায় হাদির সরকারকে উৎখাতে করতে সক্রিয় হয় হুতিরা। সুযোগ বুঝে তাদের সাথে যোগ দেন সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ।

এর ধারাবাহিকতায় গত জানুয়ারিতে রাজধানী সানার পুরো নিয়ন্ত্রণ হুতিদের হাতে যায়। অসহায় হয়ে পড়েন প্রেসিডেন্ট হাদি। গত মাসে রাজধানী ছেড়ে দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় এডেন শহরে আশ্রয় নেন তিনি। সেখান থেকে সোজা সৌদি আরব। ইয়েমেনের এমন ঘোলাটে পরিস্থিতিতে মওকা পেয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রে ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব। হাদির নির্বাচিত বৈধ সরকারকে রক্ষায় হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে আরব দেশগুলোর জোটবাহিনী। তাদের নেতা সৌদি আরব। সাথে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, জর্ডান, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান। স্থল অভিযানের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রেখেছে মিসর, জর্ডান, সুদান।

এ হামলাকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট হাদি। হুতিদের আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত হামলা অব্যাহত রাখার আবদার তার। একই সাথে হুতিদের ইরানের হাতের পুতুল বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।-এই তো চায় যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব।

হামলার প্রতি সমর্থন জানাতে বিলম্ব করেনি চতুর যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের অনুগামী ইউরোপ ও আরবের অনেক দেশ। তবে হামলা বন্ধ করতে সরব কেবল ইরান ও ইরাক। কিন্তু তাদের কথা কে শোনে! ইয়েমেনে হামলায় সৌদি আরবকে গোয়েন্দা ও আনুষঙ্গিক সমর্থন দেয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হামলায় সৌদি আরবের ১০০টিসহ প্রায় ১৮৫টি যুদ্ধবিমান অংশ নিচ্ছে। সৌদি আরবের অধিকাংশ বিমানই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া। অন্যান্য অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রও এসেছে একই মিত্রের কাছ থেকে। চমৎকার ফন্দি যুক্তরাষ্ট্রের। মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত থাকলে তার অস্ত্র ব্যবসা জমজমাট হয়। তেলের চাহিদা অনায়াসেই পূরণ হয়। ক্ষমতায় পুতুল সরকার বসিয়ে যেমন ইচ্ছে তেমন করে খেল খেলা যায়।