নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী স্নানোত্সবে
স্টাফ রিপোর্টার: নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে শুরু হওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের অষ্টমী স্নানোত্সবে প্রচণ্ড ভিড়ে পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নদের ১৬টি ঘাটের মধ্যে রাজঘাটে স্নান করলে বেশি পুণ্য অর্জন হবে এ আশায় ওই ঘাটে লোকজনের ভিড় বেশি হয়। হঠাত করে একটি ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার গুজবে লোকজনের হুড়োহুড়িতে অনেকে নিচে পড়ে গেলে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। লাঙ্গলবন্দের স্নানের ইতিহাসে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা এটিই প্রথম বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন ও লাঙ্গলবন্দ স্নান উদযাপন পরিষদের সেক্রেটারি বাসুদেব চক্রবর্তী ১০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। নিহত প্রত্যেক পরিবারকে লাশ সত্কারের জন্য স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার ভোর ৫টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড থেকে তিথি শুরু হওয়ার পরেই ব্রহ্মপুত্র নদে ১৬টি ঘাটে স্নানে নামে হাজার হাজার হিন্দু পুণ্যাথী। স্নানোত্সব শেষ হবে আজ শনিবার ভোর ৬টা ৫৯ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে। পুণ্যস্নানের জন্য লাঙ্গলবন্দে যে ১৬টি ঘাট ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে রাজঘাটকে প্রধান বা বড় ঘাট হিসেবে ধরা হয়। আগতদের বিশ্বাস, ১৬টি ঘাটের মধ্যে রাজঘাটে স্নান করতে পারলে পাপমোচন নিশ্চিত হয়ে থাকে। তাই এ ঘাটে পুণ্যার্থীদের ভিড়ও থাকে বেশি। সকাল ৯টার দিকে রাজঘাট সংলগ্ন একটি বেইলি ব্রিজের ওপর হঠাত করে এক নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে ব্রিজের এক পাশে বসে যান। ওই সময়ে পেছন থেকে মানুষের স্রোতের সাথে আসা কয়েকজন ধাক্কা খেয়ে ব্রিজের মধ্যে পড়ে গেলে ব্রিজ ভেঙে গেছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় লোকজন হুড়োহুড়ি করে ছুটতে থাকে। ওই সময়ে পদদলিত হয়ে আহত হন অনেকে। তাদের মধ্যে ১০ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান।
নিহতরা হলেন মানিকগঞ্জের জাদরা এলাকার বলাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী মালতি দাস (৬০) ও তার ছেলে নিতাই (নিত্য) গোপল দাস (৩০), গোপালগঞ্জ জেলার গোসালকান্দি গ্রামের নকুল চন্দ্র বিশ্বাস (৫৫), কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কালিপদ নন্দির ছেলে রঞ্জিত চন্দ্র নন্দি (৫৫), কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির নারায়ণ সাহার স্ত্রী কানন সাহা (৫০), কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের পরিমল সাহার স্ত্রী তুলশি দেবনাথ (৫২), ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকার নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী ভগবতি দাস (৫০) ও তার পুত্রবধূ রাখী দাস (২৮), নোয়াখালী জেলার কবিরহাটের অনিল চন্দ্র নাগের স্ত্রী ভানুমতি নাগ (৫০) ও পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার মৃত বিজেন্দ্র লাল সাহার স্ত্রী সুচিত্রা রানী সাহা (৭০)। নিহতদের মধ্যে নকুল চন্দ্র বিশ্বাস মাদারীপুরের চরমুগরিয়া কলেজের অধ্যাপক।
এদিকে স্নানে এবার প্রচণ্ড অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা গেছে। স্নানঘাটগুলোতে কচুরিপানা পরিষ্কার না করায় পুণ্যার্থীদের চরম দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা পোয়াতে হয়। ঠিকমতো খনন না করায় অনেক ঘাটে সকালেই কাদামাটিতে পানি ময়লা হয়ে যায়। ১০ জনের মৃত্যুর পর স্নানে লোকজনের উপস্থিতি কিছুটা হ্রাস পায়।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনারা নাজমীন জানান, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। এ সময় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং তিনিসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি স্রেফ একটি দুর্ঘটনা। ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি গুজব ছিলো। বন্ধের দিন হওয়ায় ওই স্নানঘাটে পুণ্যার্থীদের ঢল নেমেছিলো। ভিড় অত্যন্ত বেশি হওয়ায় পদদলিত হয়ে ১০ জন মারা যান। গত বছর রাস্তাটি ছিলো ১২ ফুট। অথচ এবার ১৬ ফুট করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. দুলাল চন্দ্র চৌধুরী জানান, ৪টি অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে নিহতদের লাশ বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আহত কাউকে পাওয়া যায়নি। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। লাঙ্গলবন্দ স্নানোত্সব স্থলে আমাদের ৩টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। লাঙ্গলবন্দে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার জন্য রাস্তার দু পাশের অবৈধ দখলদারদের দায়ী করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। তিনি বলেছেন, জেলা প্রশাসককে ছুটির পর তদন্ত কমিটি গঠন করার অনুরোধ করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলেই আমরা রাস্তাটি প্রশস্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করবো। কারণ রাস্তার পাশের অবৈধ দখলের কারণে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়াতেই লোকজনের চাপ বেড়ে যায়। গতকাল দুপুরে তিনি লাঙ্গলবন্দে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিঞা, জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, বন্দর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মিনারা নাজমিন, ভূমি কর্মকর্তা নাহিদা বারী, বন্দর উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা, লাঙ্গলবন্দ স্নান উদযাপন কমিটির সভাপতি শংকর কুমার সাহা, সদস্য রিপন ভাওয়াল প্রমুখ।
এ সময় সেলিম ওসমান বলেন, দীর্ঘদিন হরতাল অবরোধের কারণে মানুষ আবদ্ধ অবস্থায় ছিলো। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক বড় উত্সব। উত্সবটি পড়েছে শুক্রবার এবং মানুষ লম্বা ছুটি পেয়েছে। তাই অন্যবারের থেকে এ বছর তিনগুণ মানুষ বেশি হয়েছে। তাছাড়াও গরম ছিলো অনেক বেশি। সবাই গরম বাড়ার আগেই স্নান শেষ করে চলে যেতে চেয়েছিলো। তাই লোকজনের ভিড়টা বেশি হয়ে গেছে। এরমধ্যে একটি গুজবকে কেন্দ্র করে ধাক্কা ধাক্কির ফলে এমন ঘটনা ঘটেছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিঞা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন থাকায় এবার পুণ্যার্থীর আগমন প্রচুর হয়েছে। প্রশস্ত রাস্তা বেইলী ব্রিজে এসে হঠাত্ সরু হয়ে যাওয়ায় সেখানে পুণ্যার্থীদের প্রচণ্ড ভিড় জমে গেলে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে আমার মনে হচ্ছে। দ্রুত বেইলি বিজ্র এবং এর আশেপাশের সড়কগুলো আরও প্রশস্ত করার ব্যবস্থা করা হবে। এদিকে অষ্টমী স্নানোত্সবে ১০জনের মৃত্যুর ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এ কমিটিকে ৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় এ কমিটি গঠন করা হয় বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা। তিনি জানান, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-পরিচালক ইশরাত হোসেনকে প্রধান করে গঠিত কমিটির অপর দুইজন সদস্য হলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদুর রহমান হাবিব ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মিজানুর রহমান।
রাষ্ট্রপতির শোক: রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী পুণ্যস্নানে পদদলিত হয়ে দশজনের মৃত্যু ও অনেকের আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি পদদলিত হয়ে আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিত্সা সেবা দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী পুণ্যস্নানে পদদলিত হয়ে দশজনের মৃত্যু ও অনেকের আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী মৃতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার শোক: বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূণ্যস্নানে যোগ দিতে এসে পদদলিত হয়ে নারী ও শিশুসহ ১০ জনের প্রাণহানি এবং অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ শোক প্রকাশ করেন।
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের শোক: নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে ১০ পুণ্যার্থীর নিহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। ব্রিটিশ হাইকমিশনের এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। শোকবার্তায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দে মহাষ্টমীর পুণ্যস্নানে পদদলিত হয়ে ১০ পুণ্যার্থীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে নিহতের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।