চলমান সঙ্কট : কৌশলী পথে কূটনীতিকরা

স্টাফ রিপোর্টার: সহিংসতা বন্ধ হলেও সংলাপের কোনো উদ্যোগ না থাকায় হতাশ কূটনীতিকরা। খানিকটা বিব্রতও তারা। বিশেষ করে চলমান সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সরকার ও বিরোধী পক্ষকে রাজনৈতিক সংলাপে উৎসাহ জোগাতে জোটগতভাবে তৎপর হওয়া বিদেশি বন্ধু-উন্নয়ন সহযোগীরা এতোটাই বিব্রত যে কূটনৈতিক পার্টিগুলোতেও প্রসঙ্গটি এড়িয়ে চলছেন তারা। তবে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা থেমে নেই, বরং অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ আরও জোরদার হয়েছে এবং হচ্ছে। পেশাদার ওই কূটনীতিকরা তাদের কৌশলেও কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন বলে জানা গেছে। সাম্প্রতি সরকার ও বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রীদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ বা বৈঠকে বিদেশি প্রতিনিধিরা সরাসরি সংলাপের কথা না বলে পরিস্থিতির উত্তরণ কিভাবে হবে তা জানার চেষ্টা করছেন। তারা নিজেরা কোনো মন্তব্য প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার চেয়ে রাজনীতিকদের মুখ থেকে কথা আদায়ের চেষ্টাই বেশি করছেন। সরাসরি সংলাপ শব্দ না বলে আলাপ-আলোচনা হবে বলে জোর আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। কোন কোন বৈঠকে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা রাজনীতিবিদদের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিচ্ছেন। কূটনৈতিক পল্লীতে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে এমন রাজনীতিক ও পেশাজীবীরা বলছেন, সরকার বিদেশিদের কোন আহ্বানেই সাড়া দিচ্ছে না। এ অবস্থায় কূটনীতিকদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি-ই বা করার থাকে। তাছাড়া, এটা সবাই জানেন দেশের শীর্ষ দুই নেত্রী আন্তরিক না হলে কারও উদ্যোগই স্থায়ী কোন সমাধান এনে দিতে পারবে না। সমস্যার সমাধানে বিদেশীদের সাম্প্রতি তৎপরতা প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন দেশের এমন এক কূটনীতিক গুলশানের এক আলোচনায় বলেন, দেশের মানুষ এবং বিদেশীরা সবাই একটি কথাই বলছেন তা হলো- সংলাপ। পরিস্থিতি দিনে দিনে যেদিকে যাচ্ছে সেখানে সংলাপ বা পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার কোন বিকল্প নেই। তার মতে, এ উদ্যোগ নিতে যত দেরি হবে সঙ্কট ততই প্রলম্বিত হবে। গেল সপ্তাহে ঢাকা সফর করে গেছেন বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের উন্নয়ন অংশীদার ডেনমার্ক সরকারের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী মগেন্স জেনসেন। বাংলাদেশে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে গেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিনি যেমন দেখা করেছেন তেমনি সরকার ও বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টি নেত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারি প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও শ্রম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে তার আলোচনা হয়েছে। সরকার, বিরোধী দল ও কূটনৈতিক সূত্রে যেসব খবরাখবর বেরিয়েছে তাতে জানা গেছে অর্থ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে রাজনৈতিক অস্থিরতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। সঙ্কট উত্তরণে সরকার অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে বলে দৃঢ় আশা প্রকাশ করেছেন ডেনিশ মন্ত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার। সেখানে আলাপ-আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন ডেনমার্কের প্রভাবশালী ওই মন্ত্রী। সংসদের বিরোধী নেতার কাছে ডেনিশ মন্ত্রী জানতে চেয়েছেন পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান কিভাবে সম্ভব? জবাবে রওশন এরশাদ তার মনোভাব তুলে ধরেছেন। অর্থ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেছেন বলে জানানো হয়েছে। ডেনিশ মন্ত্রীর সফরের কাছাকাছি সময়ে ব্রিটেনের দুজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ঢাকা সফর করেন। রাজধানীর কড়াইলবস্তিসহ যেখানে কর্মকর্তারা গেছেন সবখানেই সঙ্কট নিয়ে কথা বলেছেন। তারা একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট করেই বলে গেছেন। তা হলো- একক ভাবে কোন দেশ বা সংস্থা নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গুম, খুন, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও মানুষের বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নে গোটা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপানসহ ১৫টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকাস্থ শীর্ষ কূটনীতিকরা চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান প্রত্যাশায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে তারা জোটগতভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিএনপির শীর্ষ নেতার সাথে দেখা করে তাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিলেন। মুখোমুখি অবস্থানে থাকা প্রধান দুই রাজনৈতিক জোটের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে তারা কাজ করতে ওই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তারা সহিংসতা বন্ধের তাগিদ দিয়েছিলেন। একই সাথে সংলাপের উদ্যোগ চেয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সহিংসতা খানিকটা কমায় তাদের মধ্যে স্বস্তি এলেও সংলাপের উদ্যোগ না থাকায় আপাতত তাদের আর কোন তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখলেও তারা অনেকটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন। ডেনিশ মন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে গুলশানের এক অভিজাত হোটেলে এক অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিলেন ওই তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ইউরোপের কয়েকজন কূটনীতিক। রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে বিদেশি বন্ধুরা এখন কি ভাবছেন? সরাসরি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি ওই রাষ্ট্রদূত। তবে চলে যেতে কয়েক কদম এগিয়ে আবার ফিরে এসে বলেন, ডেনিশ মন্ত্রী আজ বিকালে (সেদিন) প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সংসদের বিরোধী নেতার সঙ্গে দেখা করবেন। তাদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়েই কথা হবে বলে আভাস দেন ওই দূত। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উন্নয়ন নিয়ে কথা হলেও খালেদা জিয়া এবং রওশন এরশাদের সঙ্গে ডেনিশ মন্ত্রীর বৈঠকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মুখ্য আলোচ্য ছিলো।

কূটনৈতিক অঙ্গনের খবর, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকার দূতরা যেমন পর্যবেক্ষণ জোরদার করার নীতি নিয়েছেন তেমনি জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার তরফেও নতুন কোন বক্তব্য আসছে না। সাম্প্রতি বিএনপির একজন মুখপাত্র নিখোঁজ হলেও কূটনৈতিক অঙ্গন থেকে উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে কোন বার্তা বা বিবৃতি আসেনি। এদিকে বিএনপি আন্দোলনের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ভাবছে। সাম্প্রতি এসব কর্মকাণ্ডকে কিভাবে দেখছেন কূটনীতিকরা। শনিবার গুলশানের একটি হোটেলে ঢাকায় সদ্য নিয়োগ পাওয়া দূতদের সম্মানে দেয়া এক পার্টিতে জড়ো হয়েছিলেন পূর্ব-পশ্চিমের প্রভাবশালী কয়েক জন কূটনীতিক। সেখানে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রসঙ্গগুলো স্থান পায়। কিন্তু মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে কূটনীতিকরা আগাগোড়ায় সতর্ক ছিলেন।