চার্জশিট চূড়ান্ত, অভিযুক্ত ৩৫ সাবেক র্যাব কর্মকর্তা আরিফ, সাঈদ, রানা ও নূর হোসেন মূল হোতা

স্টাফ রিপোর্টার: নরায়নগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন করেছেন পরিকল্পনা, আর তা বাস্তবায়ন করেন র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনার তদন্ত শেষে এমনই উপসংহারে পৌঁছেছে তদন্তকারী সংস্থা নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশ। নূর হোসেন পরিকল্পনাকারী হলেও এই মামলার প্রধান অভিযুক্ত হচ্ছেন র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব.) আরিফ হোসেন। আর লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানা ও নূর হোসেন পর্যায়ক্রমে থাকছেন শীর্ষ অভিযুক্তদের তালিকায়। প্রায় ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে চূড়ান্ত হয়েছে চাঞ্চল্যকর এ মামলার চার্জশিট। আগামী মাসের (এপ্রিল) মাঝামাঝি সময়ে আদালতে তা দাখিল করা হবে। ভারতে গ্রেফতার নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তদন্তকারীরা। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে আনার দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হওয়ায় চার্জশিট দাখিলের ক্ষেত্রে এ নিয়ে আর অপেক্ষা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘ তদন্ত শেষে আলোচিত এই মামলার চার্জশিট আমরা চূড়ান্ত করেছি। আশা করছি আগামী মাসেই তা আদালতে দাখিল করতে পারব। এর মধ্যে র্যাবের ১৭ জনসহ ১৯ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা আসলে নূর হোসেনকে ফিরে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু তাকে না পাওয়ায় চার্জশিট দিতে কোন সমস্যা নেই। কারণ তার দুই সহযোগী মোস্তফা জামাল চার্চিল ও ক্যাশিয়ার আলী মোহাম্মদ সবকিছু বলে দিয়েছে। আর যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারাই তো আদালতে নিজেদের দোষ স্বীকার করে পুরো পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডের কথা অকপটে স্বীকার করেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চার্জশিটে বলা হচ্ছে, নূর হোসেন পরিকল্পনা করে বিষয়টি নিয়ে মেজর (অব.) আরিফের সঙ্গে আলোচনা করেন। আরিফ বিষয়টি নিয়ে তারেক সাঈদ ও রানার সঙ্গে আলোচনা করেন। নূর হোসেনের সঙ্গে যে আর্থিক লেনদেন হয়েছে তাও আরিফের মাধ্যমে। লেনদেনকৃত টাকার একটি বড় অংশ আরিফ একাই মেরে দিয়েছেন। নূর হোসেনকে পাওয়া গেলে লেনদেনকৃত অর্থের সঠিক পরিমাণ জানা যেত।

চার্জশিটের তথ্যমতে, পুরো কিলিং মিশনের নেতৃত্বে ছিলেন আরিফ। তবে অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার খুন হওয়ায় হত্যা রহস্য উদ্ঘাটন সহজ হয়েছে বলে মনে করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে আরিফ স্বীকার করেছেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুলকে হত্যার পর নূর হোসেনকেও গুম করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। কারণ সে বেঁচে থাকলে যে কোন সময় ঘটনা ফাঁস করে দিতে পারে।

কেন এই হত্যার মিশন

আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আরিফ বলেছেন, এলাকার আধিপত্য নিয়ে কাউন্সিলর নজরুলের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না নূর হোসেন। এ কারণেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এজন্য নূর হোসেন বিপুল পরিমাণ টাকা দিলেও কত টাকা দিয়েছেন তা কেউ স্বীকার করেননি। তবে ফ্লাট কেনাসহ বিভিন্ন সময় নূর হোসেনের কাছ থেকে আরিফ যে টাকা নিয়েছেন তার প্রমাণ তদন্তে মিলেছে। চার্জশিটেও লেনদেনের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে বলে নিশ্চিত করেছেন কর্মকর্তারা।

আলোচিত এই খুনের দুটি মামলায় এ পর্যন্ত ২০ জন র্যাব সদস্যসহ ৩০ জন গ্রেফতার হয়েছেন। আদালতে ১৬৪ ধারায় ১৭ জন র্যাব সদস্যসহ ১৯ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এদের মধ্যে র্যাবের তিন কমর্কতাও রয়েছেন। এছাড়া ১৪ জন র্যাব সদস্যসহ ১৯ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। কনস্টেবল শিহাব ছাড়াও পুরো ঘটনার সঙ্গে ছিলেন এসআই পূর্ণেন্দু বালা, হাবিলদার ইমদাদ, সিপাহী তৈয়ব, ল্যান্স নায়েক বেলাল, হিরা, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, এবি আরিফ, চালক নাজিম ও দেলোয়ার। তারাও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম আদালতে হাজিরা শেষে ফেরার পথে নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের অদূরে র্যাবের কয়েকজন সদস্য তাদের গাড়ি থামায়। সেই গাড়ির পেছনে অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকারের গাড়ি ছিল। র্যাব সদস্যরা নজরুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন, লিটন, তাজুল ইসলাম, তাদের গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর এবং পিছনের গাড়িতে থাকা অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার ও তার গাড়ি চালক ইব্রাহিমকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ঘটনার তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ ভেসে ওঠে।

Leave a comment