বাজলো আখেরি হুইসেল : ৪ মরসুমের ৭০ কোটি টাকার চিনি অবিক্রিত
দর্শনা অফিস: কেরুজ চিনিকলের ২০১৪-১৫ আখ মাড়াই মরসুমের কার্যক্রম এবারের মতো সম্পন্ন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে রেওয়াজ অনুযায়ী আখেরি হুইসেল বাজিয়ে মাড়াই কার্যক্রমের সামপনী ঘোষণা করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। মাড়াই দিবসের নির্ধারিত দিন ও আখের পরিমান বাড়লেও চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। মিলের ৪ মাড়াই মরসুমের প্রায় ৭০ কোটি টাকার চিনি অবিক্রিত রয়েছে। অতিরিক্ত একটি গোডাউন নির্মাণ করেও চিনি রাখা নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে মিল কর্তৃপক্ষ।
এবারের কেরুজ চিনিকলের আখ মাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বেধে দেয়া লক্ষমাত্রা নিয়ে মিলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ৯৫ কার্যদিবসে ৯৫ হাজার মেট্টিক টন আখ মাড়াই করে ৭ হাজার ৫শ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র থাকলেও ৯৬ কার্যদিবসে ৯৬ হাজার ৬৬৭ মেট্টিক টন আখ মাড়াই করা হয়েছে। ৭৭ বছর বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মিলটির যন্ত্রাংশের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া চিনি আহরণের হার কমেছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। ফলে আখ মাড়াই বেশি করা হলেও চিনি আহরণ তথা উৎপাদনের হার হ্রাস পেয়েছে। যার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এবার উৎপাদিত চিনির পরিমাণ ৪ হাজার ৮শ মেট্টিক টন। যা লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম।
মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ আজিজুর রহমান বলেছেন, কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্ম দক্ষতা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার কারণেই বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মিলটি মাড়াই কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। চলতি মাড়াই মরসুমসহ গত ৪ মাড়াই মরসুমের ১৮ হাজার ৫৩ মেট্টিকটন চিনি মিলের গোডাউন অবিক্রিত অবস্থায় রয়েছে। যার বাজারদর ৬৬ কোটি ৬৯ লাখ ৬১ হাজার টাকা। চিনি রাখার জন্য এরই মধ্যে অতিরিক্ত একটি গোডাউন নির্মান করেছে মিলকর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ১৮০৫ সালে মি. জন ম্যাকসওয়েল নামক এক ইংরেজ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতের কানপুরে জাগমু নামক স্থানে মদ কারখানা চালু করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে নাম, স্থান, মালিকানা, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী কর্মকাণ্ড পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে। ১৮৪৭ সালে মি. রাবর্ড রাসেল কেরুজ অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে ওই মদ কারখানার সাথে যুক্ত হন এবং কালক্রমে তা কিনে নেন। উত্তর ভারতের রোজাতে অবস্থাকালীন ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের সময় কারখানাটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরে তা পুনর্নির্মাণ করে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠন করে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়। রোজাতে ব্যবসায় উন্নতি লাভ করলে আসানসোলে ও কাটনিতে কোম্পানির শাখা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ১৯৩৮ সালে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১ হাজার টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার প্রুপ লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষ্যে আরো একটি শাখা তৎকালীন নদীয়া জেলার বর্তমানে দর্শনায় স্থাপন করা হয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এ কারখানাটি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ১৯৬৮ সালে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি পাকিস্তান লিমিটেডের স্থলে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইপিআইডিসির ওপর ন্যাস্ত করার সরকারি প্রচেষ্টা সুপ্রিমকোর্টের রায়ে অকার্যকর হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় করণ করা হয়। তখন থেকেই আজ পর্যন্ত কেরুজ চিনিকলটি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। ৭৭ বছর বয়সী পুরোনো এ মিলটির বর্তমান অবস্থা একেবারেই নাজুক। জোড়াতালি দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে মিলটির কার্যক্রম। সরকার এ মিল থেকে প্রতি বছর শ শ কোটি রাজস্ব আদায় করলে আজো লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। প্রায় ৭০ বছর মিলের মুনাফা অর্জন করলেও তার ছিটে ফোটাও মিলের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেনি সরকার। মিলের ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সব ধরনের ধকল সামলে ফি বছর মাড়াই কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হচ্ছে। ফলে গুনতে হচ্ছে লোকসান।