সঙ্কট নিরসনে দিন দিন বাড়ছে কূটনৈতিক চাপ

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে সহিংসতা বন্ধ এবং রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে দিন দিন বাড়ছে কূটনৈতিক চাপ। চলমান সঙ্কটের ৬০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে সরকার ও বিএনপির ওপর এ চাপ প্রয়োগ করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তারা বলছেন, সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। দেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধি, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ওপর এ পরিস্থিতি ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুগো সোয়্যারে, জাতিসংঘ মানবাধিকারসংক্রান্ত হাইকমিশনার জায়িদ রাদ আল সাদ, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র মনিকা শাই প্রায় একই রকম অভিমত ব্যক্ত করেন। সম্প্রতি ঢাকায় ১৬ কূটনীতিকের একটি গ্রুপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করে সহিংসতা বন্ধ এবং সরকার ও বিএনপির মধ্যে আস্থা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। তারা সহিংসতা বন্ধের দাবিতেও সোচ্চার।

বর্তমান অচলাবস্থার ২ মাস পূর্ণ হওয়ায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ অনেক বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার ও বিএনপি বহির্বিশ্বকে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে তৎপর। বিএনপি দেশ ও বিদেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিতে ভুল ব্যাখ্যা করতে যাতে না পারে সেই লক্ষ্যে বিদেশিদের সাথে জোরেশোরে সম্পৃক্ত হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী বর্তমানে জেনেভায় সফরে গিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার জায়িদ রাদ আল হোসেইনকে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের সাথে দেখা করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় ব্যস্ত।

অপরদিকে বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে জাতিসংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করছেন। তিনি সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সাথে বৈঠক করেছেন।

ওসমান ফারুক নিশা বিসওয়ালের সাথে তার বৈঠকের কথা নিশ্চিত করেন। ঢাকা থেকে টেলিফোন করা হলে ওসমান ফারুক বলেন, আমি শুধু এটা নিশ্চিত করছি যে, নিশা বিসওয়ালের সাথে আমার বৈঠক হয়েছে। সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না। কারণ অনেকে অনেকভাবে এটার ব্যাখ্যা করে। ফলে আমরা যে বর্তমান পরিস্থিতির একটা সুষ্ঠু সমাধান চাই সে সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকেও এ বিষয়ে কিছু বলা হবে না।

ঢাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে ১৬ জনের গ্রুপটি সরকার ও বিএনপির মধ্যে মধ্যস্থতা করে আস্থা সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানত ইউরোপ ও আমেরিকার প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত এ গ্রুপের তৎপরতায় সরকার ও বিএনপি উভয়পক্ষই খানিকটা নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। কূটনীতিকদের এ গ্রুপটি তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখবে বলে জানিয়েছে। তবে এ গ্রুপে যোগ দেননি ভারত, চীন ও রাশিয়ার কূটনীতিকরা। তারা গোটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং নিজেদের মধ্যে বৈঠক করছেন। ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী উভয় গ্রুপের সাথেই সমানভাবে যোগাযোগ রাখছেন। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গোটা পরিস্থিতির নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং সরকার ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান: বাংলাদেশে সহিংসতা বন্ধে আস্থা গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুগো সোয়্যারে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে গত ৬০ দিন ধরে চলতে থাকা সহিংসতা ও অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর জন্যে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ব্রিটেন দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুতরাং আমি বিশেষভাবে দুঃখিত যে, গত ৬০ দিন ধরে যে সহিংসতা ও অচলাবস্থা চলছে তাতে বাংলাদেশের অনেক জনগণের ওপর জীবন-জীবিকা, শিক্ষা এবং নিরাপত্তায় বেশ প্রভাব পড়ছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে এটার কোনো ঠাঁই নেই।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ব্রিটেন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল, সরকার এবং অপরাপর সমাজের প্রতি সহিংসতা বন্ধে যে আস্থা সৃষ্টির পদক্ষেপ প্রয়োজন তা গ্রহণ করা, উত্তেজনা কমানো এবং সবার মিলিত ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য আহ্বান জানায়।

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার: জাতিসংঘের মানবাধিকারসংক্রান্ত হাইকমিশনার জায়িদ রাদ আল হোসেইন তার বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি, জেনেভা সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সাথে বৈঠকে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার সঙ্কট নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন। জায়িদ রাদ আল হোসাইন আন্তর্জাতিক মানবাধিকারসংক্রান্ত ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বে খুবই প্রভাবশালী। তিনি জর্ডানের বাদশার ভাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী তাকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার তার বার্ষিক প্রতিবেদনের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার বিস্তৃতির সর্বশেষ শোকের ঘটনা হল মুক্তচিন্তার ব্লগার ও তার স্ত্রীর ওপর আতংকজনক হামলা। আগুন জ্বালিয়ে হামলা এবং রাজনৈতিক দলগুলো ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় শিশুসহ কমপক্ষে ৮০ জন নিহত হয়েছেন। নাগরিক সমাজ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এটা শুধু উগ্রপন্থি গ্রুপের দ্বারাই নয়, বরং সরকারের কড়া প্রতিক্রিয়ার শিকারও হচ্ছে। আমি সব রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি মহাসচিবের (জাতিসংঘ মহাসচিব) আহ্বানের সাথে যোগ দিয়ে বলতে চাই যে, সহিংসতার বিস্তার রোধ করুন, রাজনৈতিক সংলাপের পথ খুঁজে বের করুন এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখান।

এদিকে বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সাথে বৈঠকে জাতিসংঘ মানবাধিকারসংক্রান্ত হাইকমিশনার জায়িদ রাদ আল হোসেইন বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি জোর দিয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে যোগ দিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেনেভা যান। এ কাউন্সিলে বাংলাদেশ বর্তমানে সদস্য। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠকের পাশাপাশি জায়িদ রা’দ আল হোসেইনের সঙ্গে মন্ত্রীর বৈঠক হয়। বৈঠকে মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে আলোচনার প্রাক্কালে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনায় উঠে আসে। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারকে অবহিত করেন যে, বিএনপি-জামায়াত যে কায়দায় সহিংসতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তা আইএস (ইসলামী স্টেট) এবং অন্যান্য উগ্র জঙ্গিদের কৌশলের সাথে মিলে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার তার দফতরের সাথে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের নিয়মিত তথ্য বিনিময় এবং যোগাযোগ রক্ষার পরামর্শ দেন।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৬ বিদেশি কূটনীতিকদের একটি গ্রুপ সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে যে পৃথক বৈঠক করেছেন, সে সম্পর্কে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র মনিকা শাই বৃহস্পতিবার বলেন, রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট এবং অন্যান্য মিশন প্রধানরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠকে সব দলের সহিংসতা থেকে বিরত থাকা, রাজনৈতিক উত্তেজনা কমাতে আলোচনা করা এবং আস্থা বৃদ্ধির পদক্ষেপ খুঁজে বের করার প্রতি জোর দিয়েছেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ও যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের এশিয়া প্যাসিফিকবিষয়ক উপকমিটির নবনিযুক্ত সভাপতি ম্যাট স্যালমনের সাথে তার ক্যাপিটাল হিলের কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপকালে রাষ্ট্রদূত বলেন যে, এ মুহূর্তে সংগ্রাম কার্যত উগ্রবাদী, যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে। দশম সংসদ নির্বাচনের এক বছরপূর্তিতে বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াতে ইসলামী অবিরত অবরোধ ও হরতালের ডাক দেয় এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বোমা বিস্ফোরণ, যানবাহনে অগ্নিকাণ্ডের মাধ্যমে নির্বিচারে নিরাপরাধ মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। সরকার বর্তমানে স্বাধীনতাবিরোধী এবং উগ্রবাদীদের নির্মূলে বদ্ধপরিকর।

বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ডেলিগেট প্রধান জিন ল্যাম্বার্টের সাথে বৈঠক করেছে সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের ছয় সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পলিটিকেল আর্জেন্ট সল্যুশন অ্যাডভাইজার সাবিনা মায়া। বৈঠকে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনা হয়। জিন ল্যাম্বার্ট সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানান। বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলুর রশিদ বুলু সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

 

Leave a comment