ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের আমৃত্যু কারাদণ্ড

স্টাফ রিপোর্টার: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বারকে আমৃত্যু কারাভোগের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়ায় জন্ম নেয়া ৮৩ বছর বয়সী পলাতক এ যুদ্ধাপরাধী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে অবস্থান করছেন।

রায়ে বলা হয়েছে, আবদুল জব্বারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও দেশান্তরে বাধ্য করার মতো যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ তিনি করেছেন তাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য। কিন্তু বয়স বিবেচনায় তাকে আমৃত্যু কারাভোগের দণ্ড দেয়া হলো। রায়ে প্রমাণিত হওয়া চারটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একটিতে ২০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে তাকে আরও ২ বছর কারাভোগের আদেশ দেয়া হয়েছে। প্রসিকিউশনের আনা ১ নম্বর অভিযোগ- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়িতে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, নাথপাড়া ও কুলুপাড়ার শতাধিক বাড়িতে লুট ও অগ্নিসংযোগ; ২ নম্বর অভিযোগ- ফুলঝুড়িতে একজনকে হত্যা এবং ৩৬০টি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ; ৩ নম্বর অভিযোগ- নলীতে ১১ জনকে হত্যা, ৬০টি বাড়ির মালামাল লুট ও অগ্নিসংযোগ এবং পঞ্চম অভিযোগ- আঙ্গুলকাটা এবং মঠবাড়িয়া থেকে ৩৭ জনকে আটক, মালামাল লুট, অপহরণ, নির্যাতন, ১৫ জনকে গুরুতর জখম এবং ২২ জনকে হত্যার জন্য জব্বারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আর চতুর্থ অভিযোগ- ফুলঝুড়িতে প্রায় ২শ নিরস্ত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার জন্য জব্বারকে ২০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার অর্থ না দিলে আরও ২ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। এর আগে বয়স বিবেচনায় একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর আমীরের দায়িত্ব পালনকারী গোলাম আজমকেও আমৃত্যু সাজা ভোগের অথবা ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।

এছাড়া বয়স বিবেচনায় আমৃত্যু কারাভোগের আদেশ দেয়া হয় সাবেক মন্ত্রী বিএনপি নেতা আবদুল আলিমকেও। এ দুজনই ইতোমধ্যে মারা গেছেন। বয়স বিবেচনায় তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে আমৃত্যু কারাভোগের আদেশ পেলেন আবদুল জব্বার। তবে এই প্রথম কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অর্থদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালের অপর দু সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকও উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে এ রায় ঘোষণা করা হয়। ১৪১ পৃষ্ঠার রায়ের সার-সংক্ষেপ ট্রাইব্যুনালে পড়ে শোনানো হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আবদুল জব্বার এক মাসের মধ্যে আপিল করতে পারবেন, তবে সেক্ষেত্রে তাকে আগে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পলাতক থাকাবস্থায় এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই।

২০১৩ সালের ১৯ মে থেকে জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের বিরদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। এর আগেই ২০০৯ সালেই তিনি আমেরিকায় পালিয়ে যান। একাত্তরে হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিত করাসহ তার বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনেন প্রসিকিউশন। অভিযোগ আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল একই বছরের ১২ মে আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জব্বারকে গ্রেফতার করতে না পারায় নিয়ম অনুযায়ী তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাতেও তিনি হাজির না হওয়ায় গত বছরের ৮ জুলাই তাকে পলাতক ঘোষণা করে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরুর আদেশ দেয়া হয়। এরপর ১৪ আগস্ট ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (চার্জ) গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। পলাতক থাকায় ট্রাইব্যুনালে জব্বারের পক্ষে একজন আইনজীবী নিয়োগ দেন। বিচার শেষে গত বছর ৩ ডিসেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।

এ রায়টি ছিলো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত দুটি ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত ১৭তম রায়। এসব রায়ের মধ্যে চারটি মামলায় মোট পাঁচজন পলাতক আসামির সাজার আদেশ হল। ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার এবং নবম রায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। আর দ্বাদশ রায়ে ফরিদপুরের বিএনপি নেতা জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারেরও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। পলাতক থাকায় এ চারজনের কেউ আপিলের সুযোগ পাননি।

পেশায় প্রকৌশলী আবদুল জব্বার ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচনে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির সংগ্রাম যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে তখনও মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবে মঠবাড়িয়া-বামনা-পাথরঘাটা আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জব্বার সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন। ১৯৮৬ সালে তিনি যোগ দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে। পিরোজপুর-৪ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

রায়ে গণজাগরণের ক্ষোভ: এদিকে আবদুল জব্বারের আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে অপরাধের ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। রায় শোনার পর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হয়ে আবার শাহবাগে এসে শেষ হয়।

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে আবদুল জব্বারের আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। এ রায় আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জব্বারকে বয়স বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ অপরাধীর রায় বয়স বিবেচনায় নয়, অপরাধের ওপর ভিত্তি করে রায় হওয়া উচিত ছিলো। তাই এ রায় পুনর্বিবেচনার দাবি জানাই আদালতের কাছে।

সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরামের সন্তুষ্টি: অন্যদিকে সেক্টরস কমান্ডার্স ফেরামের পাঠানো এক বিবৃতিতে রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলা হয়েছে, আবদুল জব্বার যেসব অপরাধ করেছে তাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য ছিলো বলে ফোরাম মনে করে। তবে বয়স বিবেচনায় তাকে যে শাস্তি দেয়া হয়েছে তাতে ফোরাম সন্তুষ্ট। এখন জব্বারকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকরের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। প্রসিকিউটরদের প্রতিক্রিয়া: রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম বলেন, আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। কিন্তু আমাদের চাওয়া ছিলো মৃত্যুদণ্ড। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, আমরা দু ধরনের রায় পেয়েছি। এর আগে ট্রাইব্যুনাল বলেছিলো, এ ধরনের অপরাধে বয়স বিবেচ্য হতে পারে না। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল বয়সের বিবেচনায় রায় দিলেন। এর আগে আমরা দেখেছি গোলাম আযমকেও বয়স বিবেচনায় কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। পলাতক জব্বারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেয়া রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মোহাম্মদ আবুল হাসান বলেন, আসামি পলাতক থাকায় আরও তথ্য পেলে প্রতিযোগিতার সুযোগ পেতাম। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপিল করার ক্ষমতা আমার নেই। সেটা আসামিকেই করতে হবে।