সহিংসতা-নাশকতায় প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক

২০ দলীয় জোটের অনির্দিষ্ট অবরোধের মধ্যে ডাকা ৭২ ঘণ্টার হরতাল শুরুর আগে শুক্রবার রাত ১১টা থেকে ও শনিবার ভোরের মধ্যে অগ্নিবোমায় গাইবান্ধা ও বরিশালের গৌরনদীতে ঝরে গেছে ১০টি তাজা প্রাণ। এ নিয়ে চলমান অবরোধে অর্ধশতাধিক মানুষকে অগ্নিবোমায় পুড়ে মরতে হলো। তথ্য মতে, শনিবার রাতে ঢাকাতে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গুলি, বগুড়ায় ট্রাকে অগ্নিবোমা, খুলনায় বইমেলায় বোমাহামলা এবং রাজশাহী রেলস্টেশনে ককটেল বিস্ফোরণের খবর এসেছে গণমাধ্যমে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সহিংসতা-নাশকতায় প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক। গণমাধ্যমে আহতদের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে তা দেখে যে কারোরই নাশকতাময় বর্তমান রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলার কথা। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে এ ধারাবাহিক নাশকতায় জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলেও বাস্তবতা যে, আমাদের রাজনীতিবিদরা পরিস্থিতি নিরসনে একটুও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। যা আরো ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে চলেছে। একটি দেশে যদি ক্রমাগত এহেন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চলতে থাকে, নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারার মহোৎসব চলে, তাহলে নির্দ্বিধায় এমন দেশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
অথচ এ দেশের মানুষ বরাবরই শান্তিপ্রিয়, তারা এমন রাজনীতি প্রত্যাশা করে না, যে রাজনীতি উন্নয়নের পরিবর্তে দেশকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। সত্য যে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা আন্দোলনে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উৎপাদন, উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, কৃষিসহ অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশবাসী আজ ত্যক্ত-বিরক্ত। জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে না বেরিয়েও মানুষের উপায় নেই।
অন্যদিকে ঘর থেকে বেরোলেই মৃত্যু তাদের তাড়া করে ফিরছে। অথচ দেশের প্রধান দু রাজনৈতিক দলের নেতারা যার যার অবস্থানে অনড় রয়েছেন। এ অবস্থায় কোনো দেশ চলতে পারে না। সঙ্গত কারণেই এ পরিস্থিতির অবসান কাম্য। দেশে যে হারে অগ্নিবোমা নিক্ষেপসহ সহিংস ঘটনার বিস্তার ঘটেছে, তা কোনো সভ্য সমাজ-রাষ্ট্রের প্রত্যাশা হতে পারে না। রাজনীতির নামে নাশকতা-সহিংসতা গণতন্ত্র বা আন্দোলনের ভাষা হতে পারে কী? রাজনীতিকরা যে এটা বোঝেন না তেমনটিও নয়। তাহলে তারা কীসের স্বার্থে এ পরিস্থিতি জিইয়ে রেখেছেন, জনগণকে প্রাণঘাতী পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন- তা দেশবাসীর জানার অধিকার রয়েছে। বিরোধী পক্ষ লক্ষ্যে পৌঁছুনো না পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
সরকার পক্ষ বলেছে, নাশকতাকারীদের শক্ত হাতে দমন করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শুক্রবার রাত ১১টায় পুলিশ পাহারার মধ্যেও যাত্রীবাহী বাসে হামলায় দু শিশুসহ ছয়জন নিহত হয়েছে গাইবান্ধায়। পুলিশ পাহারায়ও যদি নাশকতা রোধ করা না যায়, তাহলে সাধারণভাবে যারা চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন তাদের অবস্থা কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। এ ঘটনায় জননিরাপত্তায় সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিও প্রকট হয়ে ওঠে বৈকি। অত্যন্ত পরিতাপের যে, ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের মধ্যে নাশকতা ও সহিংসতার যে বিস্তার ঘটেছে সারাদেশে, অগ্নিবোমা, ককটেল হামলায় প্রতিদিনই মানুষ হত্যা শুরু হয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক হলেও তা যখন নৈতিকতাবর্জিত সন্ত্রাস-নাশকতার সমার্থক হয়ে উঠলে তা পরিহারই শ্রেয়। যে রাজনীতি মানুষের স্বাধীন বিচরণের অধিকার হরণ করে, অর্থনীতির ক্ষতি করে, শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলে পঙ্গু, তা কোনো আদর্শ রাজনীতি হতে পারে না। ফলে রাজনীতির এই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসাটাই সঙ্গত। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দেশের মানুষ মুখিয়ে আছে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতির আশায়। এ অবস্থায় রাজনীতিবিদদের কর্তব্য হওয়া উচিত দেশবাসীর মুক্তির উপায় খুঁজে বের করা। দেশবাসীর কাঁধের ওপর রাজনৈতিক সন্ত্রাস ঝুলে থাকলে তা কখনো ইতিবাচক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে না- এটা রাজনীতিকদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চরম থেকে চরমতম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এভাবে কতোদিন একটি রাষ্ট্র চলতে পারে? রাষ্ট্রের উচিত মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দেয়া, তেমনি অনিশ্চিত, ভীতিকর পরিস্থিতি থেকেও মুক্ত করা। উভয় রাজনৈতিক দল পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে অবিলম্বে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশবাসীকে মুক্তি দেবে বলেই আমরা প্রত্যাশা করি।

Leave a comment