সাইফুল ইসলাম রাজ: আফজাল হোসেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের আল ফিকহ বিভাগের ছাত্র। ৯ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তার মাস্টার্স এখনও শেষ হয়নি। ২০১০ সালের শেষের তার অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও সেই পরীক্ষা হয়েছে ২০১৩ সালে। বছর খানেক আগে সে অনার্স পরীক্ষা দিতে পারলেও ওই ব্যাচের মানোন্নয়ন পরীক্ষা এখনও শুরু হয়নি। সে কারণে আফজাল মাস্টার্স পরীক্ষাও অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। চলতি বছরেরও মাস্টার্স সম্পন্ন করতে পারবেন কি-না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আক্ষেপের সুরে আফজাল হোসেন মাথাভাঙ্গাকে বলেন, ভাই, খুব কষ্টে আছি। এতোদিনেও শিক্ষাজীবন শেষ না হওয়ায় এখন নিজেকে একজন ছাত্র পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। জানি না এ লজ্জা থেকে কবে পরিত্রাণ পাবো। সেশনজটের জন্য তিনি বিভাগীয় শিক্ষকদের অন্তর্কোন্দলকে দায়ী করেন।
ইংরেজি বিভাগের ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম। তিনি মাথাভাঙ্গাকে জানান, ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছি ৫ বছর আগে। দুর্ভাগ্য যে এখনও তৃতীয় বর্ষের গণ্ডি পেরুতে পারেনি। চলতি বছরে অনার্স শেষ করতে পারবো কি-না এটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অথচ একই সেশনের আমার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা মাস্টার্সে পড়ছে। জানি না আমার শিক্ষাজীবন শেষ হতে আর কতো বছর সময় লাগবে। জাহিদ তার শিক্ষাজীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগে সেশনজট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গত কয়েক বছরে সেশনজট আরও বেড়েছে। সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি অনুষদের অধীন ২২টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে কোনো সেশনজট নেই। বাকি বিভাগগুলোতে সেশনজট রয়েছে। অধিকাংশ বিভাগে দেড় থেকে দু বছরের সেশনজট বিরাজ করছে। কোনো কোনো বিভাগে তিন থেকে চার বছরের সেশনজট রয়েছে। নিয়মানুযায়ী, অনার্স শেষ করতে চার বছর ও মাস্টার্স করতে এক বছর সময় লাগে। অথচ সেশনজটের কারনে অনার্স শেষ করতে ৫-৬ বছর ও মাস্টার্স করতে দেড় থেকে দু বছর সময় লাগছে। হিসেব করে দেখা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষসহ আইন ও শরিয়াহ অনুষদভুক্ত আইন বিভাগে বর্তমানে ব্যাচের সংখ্যা ৮টি। ওই বিভাগের ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্স পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। আল ফিকহ বিভাগের মোট ব্যাচ সংখ্যা ৯টি। বিভাগটির ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত। মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি বিভাগ, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদভুক্ত হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ানিং, কম্পিউটার সায়েন্স, গণিত এবং ধর্মতত্ত্ব অনুষদভুক্ত আল কোরআন, আল হাদিস বিভাগে ৭-৮টি করে ব্যাচ রয়েছে। এসব বিভাগের মধ্যে ইংরেজি, ব্যবস্থাপনা, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ ও বাংলা, অর্থনীতি, হিসাব বিজ্ঞান, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স, আল কোরআন, আল হাদিস বিভাগের ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এখন মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।
২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও পরিসংখ্যান বিভাগের যাত্রা শুরু। তবে দীর্ঘ ৫ কছরের ওই দুটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এখনও অনার্স শেষ করতে পারেননি। ফিন্যান্স ও পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত। ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মিফফাদ রহমান মাথাভাঙ্গাকে জানান, তৃতীয় বর্ষ শেষ হতে দু বছর সময় লেগেছে। গত বছরের এপ্রিলে তৃতীয় বর্ষ শেষ হলেও এখনও সপ্তম সেমিস্টার শেষ হয়নি। চলতি বছরে অষ্টম সেমিষ্টার (চতুর্থ বর্ষ) শেষ করতে পারবো কি-না এ নিয়ে চিন্তিত আছি।
একই শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র মারুফ হাসান সিদ্দিকী মাথাভাঙ্গাকে জানান, গত বছরে অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনও ল্যাব ও ভাইভার পরীক্ষা বাকি আছে। ল্যাব ও ভাইভা শেষ না হওয়ায় মাস্টার্সে উঠতে পারছি না। মারুফ বলেন, আমাদের বিভাগীয় শিক্ষকদের আন্তরিকতা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্থবিরতার কারণে এ অবস্থা বিরাজ করছে।
সেশনজটের কারণ হিসেবে দেখা গেছে, বিভাগীয় শিক্ষকরা সময়মতো তাদের কোর্সের ক্লাস শেষ করেন না। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার তিন মাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের নিয়ম থাকলেও ওই নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করেন না শিক্ষকরা। জানা গেছে, কোনো কোনো শিক্ষকের খাতা মূল্যায়ন শেষে তা জমা দিতে কখনও কখনও ছয় মাস থেকে বছর খানেক সময় লাগে। অভিযোগ রয়েছে, ঠুনকো ওজু হাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘনঘন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। বছরের অধিকাংশ সময় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্ধারিত বন্ধ থাকার কারণে ক্লাস পরীক্ষাও বন্ধ থাকছে। জানা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ মাসে ক্লাস হয়েছে মাত্র ৪০টি। এর আগে ২০১২ সালে প্রশাসন বিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ৬ মাস বন্ধ ছিলো। অবরোধের কারনে গত ৯ জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। এর আগে গত বছরের ৩০ নভেম্বর বাস চাপায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিহতের জের ধরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭ দিন বন্ধ ছিলো। ছুটি শেষে ৭ জানুয়ারি আবাসিক হল ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হলেও ৯ জানুয়ারি শিবিরের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। তবে অফিস খোলা রয়েছে। স্বাভাবিক দিনগুলোতে বিশেষ করে অবরোধ চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশের পরিবেশ স্বাভাবিক হলে ক্যাম্পাস খুলে দেয়া হবে। অন্যথায় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিভাগের প্রায় দু শতাধিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। কবে নাগাদ ক্যাম্পাস খুলে দেয়া হবে এটাও প্রায় অনিশ্চিত। ঘনঘন ক্যাম্পাস বন্ধ, বিভাগীয় শিক্ষকদের উদাসীনতা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি না থাকার কারণেই মূলত সেশনজট বেড়েই চলেছে। দেশের চলমান রাজনীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ থাকায় সেশনজট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
সেশনজটের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম সরকার মাথাভাঙ্গাকে বলেন, সেশনজট আগে থেকেই ছিলো। তবে বর্তমানে কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যমান সেশনজটকে যেন অন্ততপক্ষে সন্তোষজনক পর্যায়ে আনা যায় সেজন্য কিছু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই দ্রুত ক্যাম্পাস খুলে দিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করা হবে। সেশনজটের জন্য তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতি, ক্যাম্পাসের ভৌগলিক অবস্থান ও বিভাগীয় শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাবকে দায়ী করেন।