চুয়াডাঙ্গায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাখির খামার গড়ে আর্থিক সচ্ছলতা পেয়েছে বেশ কয়েকজন যুবক

ফাইজার চৌধুরী: শখের বশেই পাখি পালন শুরু করেছিলেন চুয়াডাঙ্গা শহরের মাস্টারপাড়ার লোটাস, কেদারগঞ্জ পাড়ার আলম, সাইদ, দৌলাতদিয়াড়ের সাইফুলসহ বেশ কয়েকজন যুবক। শুরুতে এরা সকলেই ৪/৫ জোড়া করে কবুতর, বাজারিগার, ডায়মন্ড ডোভ (বিদেশি ঘুঘু) কিনে এনে লালন-পালন করে আসছিলেন। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে এদের সবাই এখন পাখির খামারী। পরিবারের অন্য সদস্যরাও পাখির দেখাশোনা থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণে ভূমিকা রাখছেন। এক সময়ের সৌখিনতা এখন পরিবারের আয়ের মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে এদের।

শহরের মাস্টারপাড়ার লোটাস বছর পাঁচেক আগে মাত্র ৪ জোড়া কবুতর ছিলো তার সম্বল। তাও আবার শখ করে পোষা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে লোটাস এখন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত কবুতরের খামারি। নিজ বাড়ির একটি ফ্লাটের ৩টি রুমের সবকটি থরে থরে সাজানো কবুতরের খাঁচা। তার খামারে রয়েছে দুর্লভ জাতের হলুদ বোখারা, শাদা বোখারা, বিউটি হোমার, সিরাজি, প্লেজার থেকে শুরু করে অন্তত ২৫টি জাতের বাহারি কবুতর। বাড়িতে ঢোকা গেটের পাশেই খুলেছেন কবুতর বিক্রির দোকান। নিম্নে ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৮০ হাজার টাকা জোড়া মূল্যের কবুতর বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে এখানে । প্রতিদিন দূর -দূরান্ত থেকে পাখিপ্রেমিরা ভিড় করেন লোটাসের কবুতরের দোকানে। তিনি জানালেন, নিয়ম মেনে লালন পালন করতে পারলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কবুতর চাষ করে সচ্ছলতার মুখ দেখা সম্ভব। প্রায় সব সময়ই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় কবুতরের খামার নিয়ে। কারণ এটিই যে আয়ের একমাত্র উৎস।

কেদারগঞ্জ পাড়ার আলম। পাঁচ বছরে বৃহৎ পরিসরে দাঁড়িয়ে গেছে তার বিদেশি পাখির খামার। প্রথমে বিষয়টি শুধু শখ হিসেবে নিলেও এখন এটাই তার জীবিকা। পাখির ছানা বিক্রি করে তিনি আয় করছেন বছরে দু থেকে তিন লাখ টাকা। আর এ কাজে সহায়তা করছেন তার স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা, ছোট ভাইসহ সকলেই। আলমের খামারে বাজারিগার, ককাটিয়েল পাখির পাশাপাশি রয়েছে নানান জাতের কবুতর। আলমের স্ত্রী স্বপ্না জানালেন, প্রতিমাসে পাখি বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয় তাদের। বাজারিগার, ককাটিয়েল জাতের বিদেশি এ পাখিগুলোর জন্ম, বংশবৃদ্ধি সবই খাঁচার মধ্যেই হয়ে থাকে।

পাখিদের মূলত দু ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ওয়াইল্ড বার্ড (বন্যপাখি), অন্যটি কেসবার্ড বা খাঁচার পাখি। ওয়াইল্ড বার্ড বা বন্যপাখি পালন করা/ধরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অপরদিকে কেসবার্ড বা খাঁচার পাখি হচ্ছে খাঁচায় পালন করার জন্য। এসব পাখি জন্ম জন্মান্তর থেকে খাঁচায় বসবাস করছে। এই আইন ভালো করেই জানেন দৌলাতদিয়াড়ের পাখি ব্যবসায়ী ও খামারী সাইফুল ইসলাম।

সাইফুলের খামারে ৭৫ জোড়া ককাটিয়েল ছাড়াও ছিলো ২১৫ জোড়া বাজারিগার। সম্প্রতি ২০০ জোড়া বিক্রির পর রয়েছে ১৫ জোড়া বাজারিগার, ২৫ জোড়া স্প্যাঞ্জেল বাজারিগার, তিন জোড়া ব্যাংলিশ বাজারিগার, নয় জোড়া ডায়মন্ড ডোভ, ছয় জোড়া হোয়াইট জাভা ও তিন জোড়া লং টেইল পাখি। দেখতে সুন্দর হওয়ায় বাজারে ককাটিয়েলের চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি। তিনি আরও জানান, পাখির খাবারের তালিকায় রয়েছে সরিষা, তিল, তিসি, কাউন, সূর্যমুখি ফুলের বীজ, পোলাওয়ের চালের ধান, চ্যানারি বীজ, কুসুম বীজ, চিনা ইত্যাদি। উপাদানগুলো বাজার থেকে আলাদাভাবে কিনে পরিমাণমতো মিশিয়ে দিতে হয়। এছাড়া প্রজননের পর কলমি শাক, ঘৃত কুমারি, বরবটি, গাজর, মসুর ডালের অঙ্কুরিত বীজ, ভুট্টা সিদ্ধ খেতে দিলে ভালো হয়। প্রতিটি পাখি দিনে গড়ে ৫০ গ্রাম খাবার খায়। এ হিসাবে প্রতি পাখির খাবারের জন্য দিনে মাত্র দু টাকা ব্যয় হয়। খামার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি দু মাসে সাইফুলের ব্যয় হয় প্রায় ২৫ হাজার টাকা। প্রথমে বিষয়টি শুধু শখ হিসেবে নিলেও এখন এটাই তার জীবিকা। পাখির ছানা বিক্রি করে তিনি আয় করছেন বছরে দু থেকে তিন লাখ টাকা। এ যুবক জানান, দেখতে সুন্দর হওয়ায় অনেকেই এসব পাখি বাসায় পালন করেন। বেশ ভালো দামে এগুলো বিক্রি করা যায়। এক জোড়া ককাটিয়েল (পুরুষ ও স্ত্রী পাখি) বিক্রি হয় দু হাজার ৮০০ থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া জাভা দেড় থেকে তিন হাজার, ডায়মন্ড ডোভ ৫০০ থেকে দেড় হাজার ও বাজারিগার ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা জোড়া বিক্রি হয়।

চুয়াডাঙ্গার পাখির খামারীরা শুধু বাণিজ্যিক উদ্দেশে পাখি পালন নয়, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির মধ্যে সঙ্করায়নের মাধ্যমে নতুন জাত তৈরির চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন প্রত্যেকেই। বিদেশি জাতের কবুতর, বিভিন্ন ধরনের পাখির খামার সম্পর্কে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. গোলাম হায়দার জানালেন, এসব পাখি লালন-পালন বা বাজারজাতকরণে কোনো আইনি বাধা নেই। পোষা পাখির রোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ তাদের দফতর থেকে দেয়া হয়ে থাকে বলেও জানালেন এ কর্মকর্তা।

বিশ্লেষকদের মতে বেকারত্ব কৃত্রিম সমস্যা। চাকরির পেছনে না ছুটে বেকাররা উৎপাদনমুখি কাজে মনোযোগী হলেই বেকারত্ব সমাধান সম্ভব। দেশের বাজারে কৃষি ও কুটির শিল্প পণ্যের চাহিদা বাড়ছেই, এ অঞ্চলের বেকাররা অল্প পুঁজিতে পাখির খামার তৈরির এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। এ ক্ষেত্রটিতে বেকারদের স্বাবলম্বীতা তাদের নিজেদের হাতেই।