উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ৩০ দিন : সহিংস নাশকতায় নিহত ৬৯

স্টাফ রিপোর্টার: লাগাতার ৩০ দিনের অবরোধ, ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় ৪১৩০ ঘণ্টার হরতালে সারাদেশে সহিংসতা, নাশকতা এবং পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্নভাবে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শুধু পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ৩২ জন। পুলিশ ও ৱ্যাবের সাথে কথিত (ক্রসফায়ার) বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ১০ জন। সংঘর্ষ ও হামলায় মারা গেছেন ১০ জন। পুলিশ ও পিকেটারদের দু পক্ষের গোলাগুলিতে মারা গেছেন ১২ জন। অন্যভাবে মারা গেছেন ৭ জন। নিহতদের মধ্যে যানবাহন শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ জন। মোট নিহতের মধ্যে ১৫ জনই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। বাকি ৪৪ জনই সাধারণ ও নিরীহ মানুষ। অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন দু শতাধিক মানুষ। শুধু ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন ১১১ জন। এ সময়ের মধ্যে সারাদেশে মোট ১১শ যানবাহনে আগুন ও ভাংচুর হয়েছে। মোট ১০ দফায় রেলে নাশকতা হয়েছে। নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হুকুমের আসামি করা হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের। এসব ঘটনায় দলের ৩৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।

টানা অবরোধ ও দফায় দফায় হরতালের মধ্যদিয়ে মাস পেরিয়েছে ২০ দলের আন্দোলন। ৫ জানুয়ারি শুরু হওয়া এ আন্দোলনে প্রতিদিনই ঘটছে সহিংস ঘটনা। রাজপথে পুড়ে কয়লা হচ্ছে মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হচ্ছে একের পর এক বিরোধী নেতাকর্মী। ইতোমধ্যে সারাদেশে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিহত হয়েছে বিরোধী নেতাকর্মীসহ ৬৯ জন। যাদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে অন্তত সহস্রাধিক যানবাহন। রাজপথের পাশাপাশি রেলপথ-নৌপথেও ঘটছে নাশকতা। এসব ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়াসহ বিরোধী জোটের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই দায়ের হচ্ছে একের পর এক মামলা। খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে দায়ের হয়েছে নতুন ৫টি মামলা। ইতোমধ্যে সারাদেশে দায়ের হয়েছে অন্তত ৭০০ মামলা। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে দেড় লক্ষাধিক। গ্রেফতার করা হয়েছে বিরোধী জোটের অন্তত ১৭ হাজার নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। তবে ২০ দলের দাবি গ্রেফতারের সংখ্যা ২৫ হাজারের মতো।

হতাহতের সংখ্যা: ৫ জানুয়ারি থেকে চলমান অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে সারাদেশে নিহত হয়েছে ৬০ জন। এর মধ্যে দলীয় কর্মী ১৭ জন ও সাধারণ মানুষ ৪৩ জন। ককটেল ও পেট্রল বোমায় নিহত হয়েছে ৩৪ জন, সংঘর্ষ ও হামলায় ১০ জন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ১৪ জন ও অন্যান্য ২ জন। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, পেট্রলবোমা হামলা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় আহত হয়েছেন বিরোধী দলের নেতাকর্মীসহ অন্তত কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতারের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন অন্তত কয়েক শ’ মানুষ।

মামলা ও গ্রেফতার: চলতি বছরের ১ থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত হামলা-ভাঙচুর, নৈরাজ্য-অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়াসহ নানা অভিযোগে সারা দেশে দায়ের হয়েছে অন্তত ৩০০ মামলা। এসব মামলায় আসামি করা হয় ৬০ হাজারের বেশি নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত ৭০০০ নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। যদিও সরকারি হিসাবে আন্দোলনের প্রথম ১৫ দিনে গ্রেফতারের সংখ্যা ৭০১৫। তবে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের তরফে গ্রেফতারের এ সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি বলে দাবি করা হয়। এদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৭ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত দলীয় জোটের ৯৫৮৫ জন নেতাকর্মী-সমর্থককে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এর মধ্যে- ১৭ জানুয়ারি ৩৯৫ জন, ১৮ জানুয়ারি ৫৮০ জন, ১৯ জানুয়ারি ৪২০ জন, ২০ জানুয়ারি ৪০০ জন, ২১ জানুয়ারি ৭০০ জন, ২২ জানুয়ারি ৭০০ জন, ২৩ জানুয়ারি ৫৮০ জন, ২৪ জানুয়ারি ৫৫০ জন, ২৫ জানুয়ারি ৫৪৫ জন, ২৬ জানুয়ারি ৫৫০ জন, ২৭ জানুয়ারি ৫২০ জন, ২৯ জানুয়ারি ৬০০ জন, ৩০ জানুয়ারি ৪৮০ জন, ৩১ জানুয়ারি ৫৮০ জন, ১ ফেব্রুয়ারি ৬০০ জন, ২ ফেব্রুয়ারি ৫০৫ জন, ৩ ফেব্রুয়ারি ৪৯০ জন ও ৪ ফেব্রুয়ারি ৩৮০ জনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। তবে বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, ১৭ জানুয়ারির পর থেকে গ্রেফতারের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। বিএনপিপন্থি কয়েকজন আইনজীবী জানান, দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের প্রতিদিনই গ্রেফতার করা হচ্ছে। তার অনেক তথ্যই গণমাধ্যমে পৌঁছে না। আবার অনেক তথ্য প্রকাশিত হয় না।

যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের চিত্র: ৫ জানুয়ারি ১০০টি, ৬ জানুয়ারি ১০টি, ৭ জানুয়ারি ২৭টি, ৮ জানুয়ারি ৪৮টি, ৯ জানুয়ারি ৪৩টি, ১০ জানুয়ারি ১৩৪টি, ১১ জানুয়ারি ৪৯টি, ১২ জানুয়ারি ৩১টি, ১৩ জানুয়ারি ১০৭টি, ১৪ জানুয়ারি  ৫০টি, ১৫ জানুয়ারি ৪০টি, ১৬ জানুয়ারি ৩৮টি,  ১৭ জানুয়ারি ৪০টি, ১৮ জানুয়ারি ১৩টি, ১৯ জানুয়ারি ৫০, ২০ জানুয়ারি ২০টি, ২১ জানুয়ারি ৪০টি, ২২ জানুয়ারি ৫৩টি, ২৩ জানুয়ারি ২৫টি, ২৪ জানুয়ারি ৬টি, ২৫ জানুয়ারি ৭টি, ২৬ জানুয়ারি ২১টি, ২৭ জানুয়ারি ৩০টি, ২৮ জানুয়ারি ২৫টি, ২৯ জানুয়ারি ২৮টি, ৩০ জানুয়ারি ২০টি, ৩১ জানুয়ারি ৪০, ১ ফেব্রুয়ারি ৩৫টি, ২ ফেব্রুয়ারি ৩১টি, ৩ জানুয়ারি ২৬টি, ৪ জানুয়ারি ১২টি যানবাহন ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া গত একমাসে রাজধানীতে ২২৭টি যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিকে কুলাউড়া, জয়পুরহাট, বগুড়া, চট্টগ্রামের মীরসরাই, কুমিল্লায় রেললাইন তুলে ফেলার ঘটনা ঘটে। ১২ জানুয়ারি নরসিংদীতে রেললাইনের ব্রিজে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। গাজীপুরে শ্রীপুরে একটি ট্রেনে পেট্রোলবোমা হামলায় ৫ যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চট্টগ্রামগামী সুবর্ণ এক্সেপ্রেসে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এছাড়া সদরঘাট ও বরিশালে  লঞ্চে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ওদিকে কাউখালী উপজেলার শিয়ালকাঠি ইউনিয়নের জোলাগাতি গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব জোলাগাতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কার্যালয়ে পাল্টাপাল্টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া দেশের কয়েক জেলায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

অতীতের আন্দোলনে হতাহতের চিত্র: ১৯৯৬ সালে ফেব্রুয়ারি-জুন মাসে ৬ষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিহত হয়েছিলো ৮২ জন। এর মধ্যে দলীয় নেতাকর্মী ৩৬ ও সাধারণ মানুষ ৩২ জন এবং অজ্ঞাত ১৪ জন।  ৮২ জনের মধ্যে পুলিশের গুলিতে ২২ জন, সংঘর্ষ-হামলায় ২৬ জন, বোমাহামলায় ১৯ জন ও অন্যান্য ১৫ জন। ২০০১ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিহত হয়েছে ৯৬ জন। এর মধ্যে দলীয় কর্মী ৭৯ জন ও সাধারণ মানুষ ১৭ জন। হামলায় ৫৫ জন, বোমায় ১৮ জন, গুলিতে ১৪ জন ও অন্যান্য ৯ জন। ২০০৬ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিহত হয়েছে ৩২ জন। এর মধ্যে দলীয় কর্মী ২৮ জন, সাধারণ মানুষ ৪ জন। হামলায় নিহত হয়েছে ২৭ জন, গুলিতে ৩ জন ও অন্যান্য ২ জন। সর্বশেষ ১০ম জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জন দলীয় কর্মী ও ৪০ জন সাধারণ মানুষ। হামলায় নিহত হয় ২৫ জন, পেট্রোলবোমায় ২২ ও অন্যান্য ১২ জন।