স্টাফ রিপোর্টার: বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকে দু হাজার কোটি টাকার রহস্যময় তহবিলের সন্ধান পাওয়া গেছে। কোনো একটি অজানা উৎস থেকে এ তহবিলের টাকা ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে (ওবিইউ) জমা হয়েছে। ওখান থেকে ওই টাকার একটি অংশ ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় স্থানান্তর করা হয়েছে। শাখা থেকে ওই সব টাকার একটি অংশ বিভিন্ন গ্রাহকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়াটি এমনভাবে করা হয়েছে যাকে মানি লন্ডারিঙের ভাষায় লেয়ারিং বা জটিল লেনদেনের মাধ্যমে টাকার উৎস বা প্রবাহ গোপন করার মতো অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কারণে ঘটনাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ থেকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগকে তদন্ত করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ২০১৩ সালের তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শক দলের পরিচালিত তদন্তে এ ঘটনা ধরা পড়ে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকরা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এবং ইসলামী ব্যাংকের ২০১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন। তারা এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাইলে ইসলামী ব্যাংক যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ব্যাংকের পরিদর্শকরা। ওই তহবিলের লেনদেনের বিষয়ে আরও বিশদ তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ থেকে ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটকে (এফআইইউ) অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে এফআইইউ থেকে আরও ব্যাপক তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ইসলামী ব্যাংকের ২০১৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও এ বিষয়ে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদনের কোথাও পরিষ্কারভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। উল্টো আড়াল করা হয়েছে অনেক তথ্য। প্রতিবেদনে তহবিলের একটি অংশকে দেখানো হয়েছে দায় হিসাবে, কিন্তু এর বিপরীতে কোনো সম্পদ দেখানো হয়নি। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে দেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় কোনো ব্যাখ্যা।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা একদম ঠিক না। এ ধরনের তথ্য আমি আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আমরা কোনো ব্যাখ্যাও দেইনি। এ ধরনের কোনো তদন্তও হয়নি।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ওই তহবিলের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পাওয়ায় এ ব্যাপারে আরও বিশদ তদন্ত হবে। এ কারণে ২০১৩ সালের তথ্যের ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকে যে তদন্ত হয়েছে সে বিষয়ে সেসব আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে সেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ইতিমধ্যে সব ব্যাংকের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলেও ইসলামী ব্যাংকেরটি এখনও হয়নি।
সূত্র জানায়, নতুন বছরের শুরুতে আগের বছরের তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ বড় বড় কিছু শাখা তদন্ত করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাকে পদ্ধতিগত পরিদর্শন বলে অভিহিত করে। সব ব্যাংকেই এ পরিদর্শন করা হয়। এতে যেসব অনিয়ম ধরা পড়ে সেগুলোর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদের সঙ্গে বৈঠক করে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং আর্থিক বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংককে কিছু অঙ্গীকার করতে হয়। ২০১৩ সালের তদন্তের ভিত্তিতে সব ব্যাংক ইতিমধ্যে এসব অঙ্গীকার করলেও ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ থেকে তদন্ত সম্পন্ন হলে এ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের উপস্থিতিতে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের একটি বৈঠকে একজন কর্মকর্তা ইসলামী ব্যাংকের তহবিলের রহস্যময়তার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। এ বিষয়ে গভর্নর তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আর তদন্ত কাজ এগোয়নি।
সূত্র জানায়, ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে (বিশেষ ধরনের ব্যাংকিং, যার হিসাব সম্পূর্ণ আলাদা) প্রায় ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা ধার বা বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে মূল প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক থেকে। ওই ইউনিটে কোনো আমানত দেখানো হয়নি। মূল প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক থেকে ওবিইউতে টাকা গেলে মূল প্রতিষ্ঠানে তা সম্পদ হিসাবে থাকত। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের মূল ব্যালেন্স শিটে এ ধরনের বিনিয়োগ দেখানো হয়নি। অর্থাৎ মূল ইসলামী ব্যাংক থেকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে কোনো অর্থ বিনিয়োগ করা হয়নি। তারপরও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে কীভাবে মূল প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা গেল- এ প্রশ্ন তুলেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
অথচ নিয়মানুযায়ী এক স্থানে ধার হলে অন্য স্থানে সম্পদ হিসাবে থাকতে হবে। সম্পদই যদি না থাকে তাহলে ধার দেয়া হবে কোথা থেকে। যেটি ঘটেছে ইসলামী ব্যাংক ও তাদের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মধ্যে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ওই ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা কোথা থেকে এসেছে। এর বাইরে ইসলামী ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে প্রায় ৪৩৯ কোটি টাকার অন্যান্য দায় দেখানো হয়েছে কভার ফান্ড (বিভিন্ন দায়ের বিপরীতে রাখা তহবিল) হিসাবে। ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ওবিইউর ডিসকাউন্টকৃত বিলের বিপরীতে জমা রাখা হয়েছে ওই অর্থ। কিন্তু ওবিইউর বিল খাতে বিনিয়োগ বাদে সম্পদ ৪৫ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। এ ধরনের তহবিলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে ওবিইউ কোথা থেকে ৩৪৯ কোটি টাকার কভার ফান্ড দিলো।
অফশোর ব্যাংকিঙে অভিজ্ঞরা বলেছেন, ওবিইউর অজ্ঞাত উৎসের প্রায় ২ হাজার ৬০ কোটি টাকার প্লেসমেন্ট করা হয়েছিলো। যার মধ্যে কভার ফান্ড খাতে ৪৩৯ কোটি টাকা লেয়ারিং করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকা লেয়ারিংয়ের অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎপরতায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের ব্যাংকিং। প্রচলিত ব্যাংকিং থেকে এখানে অনেক বিধিবিধান শিথিল রয়েছে। অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের আওতায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। শুধু তাদের পুরো হিসাবটি পর্যবেক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকের আলোচিত ওই তহবিল নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত কোনো তদন্ত করতে পারছে না। এটিকে ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ থেকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগকে দেয়া হয়েছে বিশদ তদন্তের জন্য। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এ বিভাগ থেকে এ ধরনের তদন্তে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ওই বিভাগ থেকেও বিষয়টি নিয়ে তদন্তকাজ ঝিমিয়ে পড়েছে। এখন বিষয়টিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান জানান, ইসলামী ব্যাংকিং বা অফশোর ব্যাংকিংয়ের ব্যাপারে আমাদের নির্দেশনা দেয়া আছে। নির্দেশনা ভঙ্গ হলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছভাবেই বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছে। যেহেতু অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের আমানত সংগ্রহ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিস্তারিত জানাতে হয় না, এ কারণেই তা বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশদভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।
এদিকে তহবিল নিয়ে এ ধরনের বিভ্রান্তি থাকার পরও ২০১৩ সালের সবচেয়ে ভালো বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির জন্য ইসলামী ব্যাংককে দ্বিতীয় পুরস্কার দিয়েছে দি ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। গত ৩০ নভেম্বর একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এ পুরস্কার গ্রহণ করেন।
গত রোববার জাতীয় সংসদে এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ইসলামী ব্যাংকিং একান্তই একটি ফ্রড (প্রতারণা)। ভুলের ওপর নির্ভর করে ইসলামী ব্যাংকিং হচ্ছে। দুর্ভাগ্য হলো- বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এটি চালু রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) একই কথা বলছে। এটি বন্ধ করার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, ইসলামী ব্যাংকিং বন্ধ হবে কি হবে না তা মুসলিম উম্মাহর সচেতনতার ওপর নির্ভর করছে। মুসলিম উম্মাহ যখন বুঝতে পারবে ইসলামের নামে জঘন্য কাজ চলছে, তখনই এটি বন্ধ করা যাবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। রিবা ও সুদ এক নয়। রিবা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। এখানে কোনো মানবিকতা নেই। সুদ হচ্ছে কস্ট অব ফান্ড বা কস্ট অব অ্যাডমিনিসট্রেশন। যারা ধর্ম নিয়ে বেশি কথা বলেন, তারা সুদ আর রিবাকে এক করে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে একজন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, সংসদে কোনো প্রশ্ন না হলেও সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে হঠাৎ করে ইসলামী ব্যাংক সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যে কোনো অর্থ আছে কিনা তা খুঁজে দেখা উচিত।