অবরোধ থাকবে পরীক্ষাও চলবে

 

স্টাফ রিপোর্টার: আসন্ন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার মধ্যেও অবরোধ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তে এখনও অনড় আছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। অন্যদিকে অবরোধ থাকলেও ঝুঁকি নিয়েই ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী ২ ফেব্রুয়ারি থেকেই এই পরীক্ষা শুরু করতে বদ্ধপরিকর সরকার। তবে অবরোধের পাশাপাশি যেদিন হরতাল থাকবে, সেদিনের পরীক্ষা স্থগিত রাখা হতে পারে। এক্ষেত্রে হরতালের আগেরদিন সন্ধ্যায় পরীক্ষা স্থগিতের বিষয় ও সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার পরিবর্তিত তারিখ জানিয়ে দেয়া হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে ১৪ লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকসহ কমপক্ষে ৪২ লাখ মানুষ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শনিবার বিকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমি আরও মহা উদ্বিগ্ন। কেননা আমি তো সব শিক্ষার্থীর অভিভাবক। কিন্তু যথাসময়ে পরীক্ষা নেয়া ছাড়া আমাদেরই বা কী করার আছে। ৬ বছর আগেই আমরা এই রুটিন নির্ধারণ করে রেখেছি। এর মধ্যেই আমাদের একটু ঝুঁকি নিতে হবে। দু-একটা ঘটনা তো এমনিতেই ঘটে থাকে। তিনি বলেন, পরীক্ষাকে নির্বিঘœ করার লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি নেয়া সম্পন্ন হয়েছে। শিক্ষার্থীরাও প্রস্তুতি নিয়েছে। তাই আমরা পরীক্ষা পেছাচ্ছি না। বরং আমরা আশা করব, ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর কথা বিবেচনায় নিয়ে তারা (২০ দলীয় জোট) সহিংস রাজনীতির পথ থেকে সরে আসবেন। কেননা, তারা অনেক হরতাল দিয়েছেন। দিয়ে তো কোনো লাভ হয়নি। তাই আশা করছি পরীক্ষার সময় তারা কর্মসূচি প্রত্যাহার করবেন।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠন অভিভাবক ফোরামের চেয়ারম্যান জিয়াউল কবীর দুলু বলেন, চলমান সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যেও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার খবরে আমরা খুবই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনাতিপাত করছি। যদি এই পরিস্থিতির মধ্যে পরীক্ষা নেয়া হয়, তাহলে বাধ্য হয়েই সন্তানদের নিয়ে বের হতে হবে। নইলে তাদের জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে যাবে। আবার যদি পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বের হই, তাহলেও যে কেউ ককটেল-বোমায় আহত হবেন না- তার নিশ্চয়তা কে দেবে? তিনি বলেন, হরতাল হলে পরীক্ষা স্থগিত হবে, কিন্তু অবরোধে চলবে- এমন পরিস্থিতি আমরা চাই না। কেননা, পেট্রলবোমায় যত নিহত-আহতের ঘটনা রয়েছে, তার বেশিরভাগই অবরোধের সময়ে। তাই ঝুঁকি থেকেই যায়। দুলু বলেন, আমরা এই পরিস্থিতির পরিত্রাণ চাই। আমরা তাকিয়ে আছি রাজনৈতিক নেতাদের দিকে। তাদের মধ্যে ইতিবাচক সমঝোতা হলে শুধু এসএসসি পরীক্ষার্থীরাই নয় গোটা দেশ বেঁচে যায়। আমাদের আকুল আবেদন আমাদের বাঁচান।

৬ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিরোধী জোট। অবরোধের মধ্যে হরতালও ডাকা হচ্ছে। এই কর্মসূচি গোড়া থেকেই সহিংস রূপ লাভ করেছে। হরতালের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। ইতিমধ্যে অবরোধের শিকার হয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা রয়েছে। এছাড়া যাতায়াতে পেট্রলবোমার শিকার হয়ে প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালে পোড়া রোগীর ভর্তি হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব কারণে জনজীবনে চরম আতংক বিরাজ করছে। রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি পরীক্ষা দিতে বের হলে এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার আশংকাও তাই শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পিছু ছাড়ছে না। এ অবস্থায় পরীক্ষা শুরু হতে এক সপ্তাহ বাকি থাকলেও তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

এ ব্যাপারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, যারা পরীক্ষা দিচ্ছেন তারা আমাদেরই সন্তান। তারা এ দেশেরই ভবিষ্যৎ। তাদের জন্যই সবার রাজনীতি। কিন্তু যদি দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করা হয় আর গণতন্ত্র ও সুশাসন না থাকে, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎও অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আন্দোলন করছি। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলবে, যতক্ষণ না সরকার গণতন্ত্র, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা, মানুষকে শান্তিতে তার বাস্তুভিটায় বসবাসের সুযোগ করে না দেবে। আমরা আশা করব, স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য হলেও সরকার সমঝোতার পথে আসবে এবং পরীক্ষার্থীদের সুষ্ঠুভাবে লেখাপড়া ও পরীক্ষা দেয়ার পথ করে দেবে।

তবে পরীক্ষার জন্য হলেও সরকার এবং বিরোধী উভয় জোটকে সমঝোতায় যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা শিক্ষার্থীদের নিরাপদে, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে পরীক্ষায় বসার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য উভয় পক্ষকেই তাগিদ দিয়েছেন। প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, যেহেতু চলমান পরিস্থিতির কারণে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা নেয়া বিঘিœত হতে পারে, তাই এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে। এ দায়িত্ব উভয় জোটের হলেও সরকারকে এজন্য এগিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন যায়নি দু বোর্ডের: এদিকে সরকারি মুদ্রণালয় বিজি প্রেসের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরীক্ষার কয়েকদিন বাকি থাকলেও শনিবার পর্যন্ত ২টি বোর্ডে প্রশ্নপত্র পাঠানো বাকি রয়েছে। তবে এসব প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজ শেষ। এ কর্মকর্তা জানান, ঢাকার বাইরে পাঠানোর মতো কোনো ট্রাক পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রশ্নপত্র পাঠানো বাকি রয়েছে। ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলেন, এখনও দুই বোর্ডের প্রশ্ন পাঠানো হয়নি। তবে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে প্রশ্ন পৌঁছানো হবে।

সব প্রস্তুতি সম্পন্ন: ২ ফেব্রুয়ারি শুধু পরীক্ষা শুরুর প্রস্তুতিই নয়, পরীক্ষা শেষে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের প্রস্তুতিও নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ জন্য ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া-আসার পথে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, পরীক্ষা শেষে ৬০ দিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশের লক্ষ্যে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। এ জন্য রেলপথ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে পৃথক পত্র পাঠানো হয়েছে। এতে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে পরীক্ষার দিনই উত্তরপত্র এবং ওএমআর ফরমসহ গোপনীয় কাগজপত্র শিক্ষা বোর্ডগুলোতে যাতে পাঠানো যায়, সেজন্য এগুলো ডাকঘরে বা রেলস্টেশনে না পৌঁছা পর্যন্ত অফিস খোলা রাখা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে।

এর বাইরে শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খান নিজে সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (টিএনও) এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারকে (এসপি) বৃহস্পতিবার আলাদা পত্র দিয়েছেন। এতে উত্তরপত্রসহ পরীক্ষার সরঞ্জামাদির নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং প্রশ্নফাঁস করা হলে পরীক্ষা আইন ১৯৮০ ও আইসিটি আইন ২০০৬ অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থাসহ ৮ দফা নির্দেশনা রয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও পরীক্ষা সম্পর্কিত আন্তঃবোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির আহ্বায়ক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ জানান, রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে আমরা পরীক্ষা নেব নাকি নেব না- সে সিদ্ধান্ত জানানোর সময় এখনও আসেনি। আমরা ইতিমধ্যে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র পাঠিয়েছি। বিভিন্ন স্থানে প্রশ্নপত্রও পৌঁছে গেছে। শনিবার বিভিন্ন বোর্ডে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে কেন্দ্র সচিবদের নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। এক কথায় আমরা পরীক্ষা গ্রহণের শতভাগ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছি। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি, ইংরেজি মাধ্যমের এ এবং ও লেভেল পরীক্ষাকালে কর্মসূচি শিথিল করা হয়েছে। আশা করব এসএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও তাই হবে।

Leave a comment