কেরুজ শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের নবনির্বাচিত কমিটিকে অভিনন্দন

বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান তথা স্থাপনাগুলোর মধ্যে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড একটি  প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার দর্শনায় অবস্থিত এ চিনিকল থেকে শুধু চিনিই উৎপাদন হয় না, এ শিল্প প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ডিস্টিলারি ও বাণিজ্যিক খামার। যাকে বৃহৎ শিল্প-কমপ্লেক্স বললে ভুল হয় না। এ শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দ্বিবার্ষিক নির্বাচন গতপরশু শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না, এ নির্বাচন শুধু ব্যয়বহুলই নয়, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তও নয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন, একটি সিবিএ নির্বাচনে অতো ব্যয় কেন? নিশ্চয় আয় আছে, তা না হলে কেউ কী শুধু শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গাট্টি থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় করে?

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮০৫ সালে মি. জন ম্যাকসওয়েল নামক এক ইংরেজ ভারতের কানপুরে জাগমু নামক স্থানে তখনকার একমাত্র মদের কারখানাটি চালু করেছিলেন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে এর নাম, স্থান, মালিকানা, উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে। ১৮৪৭ সালে মি. রবার্ট রাসেল কেরু অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ওই প্রতিষ্ঠানটির সাথে যুক্ত হন এবং কালক্রমে তা ক্রয় করে নেন। উত্তর ভারতের ‘রোজা’তে অবস্থানকালীন ১৮৫৭ সনে সিপাহী বিপ্লবের সময় কারখানাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতঃপর তা পুনর্নির্মাণ পূর্বক জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠন করে ‘কেরু অ্যান্ড কোং লি. হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নতুন নামকরণ করা হয়। ‘রোজা’তে ব্যবসা উন্নতি লাভ করলে আসানসোল ও কাটনীতে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত  হয়। ১৯৩৮ সনে প্রাথমিকভাবে দৈনিক ১০০০ টন আখ মাড়াই ও ১৮ হাজার প্রুফ লিটার স্পিরিট তৈরির লক্ষ্যে আরও একটি শাখা তদানিন্তন নদীয়অ জেলার অন্তর্গত এই দর্শনায় স্থাপন করা হয়। ১৯৬৫ সনের পাক-ভারত যুদ্ধের পর এটি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ১৯৬৮ সনে কেরু অ্যান্ড কোং (পাকিস্তান) লিমিটেডের স্থলে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইপিআইডিসি’র ওপর ন্যস্ত করার সরকারি প্রচেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অকার্যকর হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয় এবং তখন থেকে এখন পর্যন্ত এটি কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লি. নামে বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে এ ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি বলা হয়েছে, চিনি, রেকটিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার স্পিরিট, দেশীমদ, বিলাতি মদ (জিন, হুইস্কি, রাম, ব্রান্ডি, ভদ্‌কা) ও ভিনেগার এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত মূল পণ্য এবং চিটাগুড়, ব্যাগাস ও প্রেসমাড অন্যতম উপজাত-দ্রব্য। জাতীয়করণের পর থেকে ২০১১-২০১২ অর্থ বছর পর্যন্ত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি সম্মিলিতভাবে শুল্ক, ভ্যাট, সারচার্জ, আয়কর ও লভ্যাংশ হিসেবে ৯০৩.৪৭ কোটি টাকার ওপরে সরকারি কোষাগারে প্রদান করেছে। ওই সময়কালে প্রতিষ্ঠানটি ২৭ বছর লাভ করে কিন্তু অবশিষ্ট ১৪ বছর লোকসান দেয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন, যে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানের পর লোকসানের বোঝা বাড়িয়েই চলেছে, সেই শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে অতো ব্যয় কেন? উৎপাদিত মদের ডিপোগুলোতে পোস্টিং? নিয়োগ থেকে আয়ের আশা? এরকম অনেক প্রশ্ন শুধু নির্বাচন মরশুমে নয়, কেরুজ ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যেই ঘোর ফেরে। জবাবও খুব একটা অস্পষ্ট নয়। সরকারি উদ্যোগে স্থাপিত বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত, বেসরকারি বৃহৎ শিল্প উদ্যোগের পথপ্রদর্শক। সর্বত্র ব্যবহৃত এমন একটি পণ্যের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান লোকসানে পতিত হওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না; কিন্তু এক্ষেত্রে তাই ঘটছে। উৎপাদিত চিনি অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে থাকার কারণেই শুধু নয়, নানা কারণেই মিলটি লোকসানের দায়ে ধুঁকছে।

অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, একশ্রেণির কর্মকর্তা, ঠিকাদার এবং সিবিএ নেতার সংঘবদ্ধ দুর্নীতির কারণে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি কলকারখানা, শিল্প-প্রতিষ্ঠানের এমন পরিণতি কারোরই কাম্য নয়। কিন্তু বেড়ায় যদি ক্ষেত খাওয়ার সংস্কৃতি অব্যাহত রাখে তাহলে ভবিষ্যতে সরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। তাতে বেসরকারি খাতের শ্রমিকরাও ক্ষতির শিকার হবেন, তারা ন্যায্য মজুরি বঞ্চনার মধ্যে পড়বেন। কর্মসংস্থানের অভাবে নষ্ট হবে সমাজের স্থিতিশীলতা। কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) যেন বন্ধ না হয় সেদিকেই অধিক নজর দেয়া দরকার। নবনির্বাচিত কমিটি আখের গোছানোর জন্য নয়, মিলটি রক্ষা করেই শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ তথা অধিকার রক্ষায় আন্তরিক হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। নবনির্বাচিত কমিটিকে অভিনন্দন।