মুজিবনগরে পরিবেশবান্ধব উপায়ে কীটনাশকবিহীন বেগুনচাষ

মাজেদুল হক মানিক/শেখ শফি: গল্পটা মেহেরপুর জেলার গৌরীনগর গ্রামের। কীটনাশক ব্যবহারে শুধু মানব স্বাস্থ্য নয়, আমাদের পরিবেশেরও যে মারাত্মক ক্ষতি হয়, তা বুঝতে পেরেছেন এ গ্রামের চাষিরা। প্রযুক্তিগত উন্নতি আমাদের জীবনযাপনকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, দিন শেষে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আহত হয় আমাদের পরিবেশ। গল্পটা মেহেরপুর জেলার গৌরীনগর গ্রামের। কীটনাশক ব্যবহারে শুধু মানব স্বাস্থ্য নয়, আমাদের পরিবেশেরও যে মারাত্মক ক্ষতি হয়, তা বুঝতে পেরেছেন এ গ্রামের চাষিরা। আর তাই তো জমিতে কীটনাশক ব্যবহার না করে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পোকামাকড় নিধনের ব্যবস্থা নিয়েছেন এখানকার চাষিরা।

এমনই একজন কৃষক মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বেগুনচাষি বাবুল হোসেন। তিনি চলতি মরসুমে সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার করে কীটনাশক ছাড়াই বেগুন উত্পাদন করেছেন। প্রথমবারই ব্যাপক সফলতায় মুগ্ধ বাবুল হোসেনসহ আশপাশের চাষিরা। কীটনাশক দিয়ে বেগুন আবাদে তাদের প্রচলিত ধারণাই পাল্টে দিয়েছে সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ পদ্ধতি। সমন্বিত মুজিবনগর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় উপজেলা কৃষি অফিস বিভিন্ন সহযোগিতা করে ওই বেগুনচাষিকে।

বাবুল হোসেন জানান, তার আবাদি জমিতে বেগুনচাষে প্রায় ২০ হাজার টাকার কীটনাশক প্রয়োগ করতে হতো। ফেরোমন ট্র্যাপ জোগাড় করে দেয় উপজেলা কৃষি অফিস। কোনো ধরনের কীটনাশক ছাড়াই জৈবিক পদ্ধতিতে আবাদ করেছেন। চাষ, সেচ ও সারসহ অন্যান্য খরচ ৪৭ হাজার টাকা। বেগুন বিক্রি করেছেন দেড় লাখ টাকার। শুধু কীটনাশক খরচ সাশ্রয় নয়, বিষমুক্ত সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অন্যান্য চাষির উৎপাদিত বেগুনের চেয়ে তার বেগুন চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহারের মধ্যদিয়ে পরিবেশের উপকারী পোকার সাথেও তার পরিচয় ঘটেছে বলে জানান তিনি। আগামীতে শুধু বাবুল হোসেনই নন, আশপাশের চাষিরাও এ পদ্ধতিতে বেগুন আবাদ করবেন বলে জানালেন কয়েকজন বেগুনচাষি।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ হলো- কীটনাশকবিহীন পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল উত্পাদন পদ্ধতি; যা বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষি অফিসের পরামর্শে ব্যবহার করছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। দেশের কয়েকটি কোম্পানি সেক্স ফেরোমন সরবরাহ করছেন। তবে এর ব্যবহারের ব্যাপকতা এখনো লাভ করেনি। এ পদ্ধতিতে মূলত ফসলের ক্ষতিকর পোকা দমন করা হয়। রক্ষা পায় ফসল ও পরিবেশের জন্য উপকারী পোকামাকড়। আর অতিমাত্রার বিষপ্রয়োগ করা বেগুন খেতে যারা দুশ্চিন্তায় ছিলেন সেসব ভোক্তাদের জন্যও সুখবর এটি।

ক্ষেতের মধ্যে একটি বাঁশের লাঠির মাথায় একটি মুখ কাটা কৌটা ঝোলানো হয়। এর সাথে সুতা দিয়ে ঝোলানো হয় সেক্স ফেরোমন লিওর। কৌটার মধ্যে থাকে পানি ও সাবানের ফেনা। ফেরোমন লিওরের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পোকাগুলো সাবান-পানি মিশ্রণের মধ্যে পড়ে মারা যায়। এতে অন্য কোনো পোকা আকৃষ্ট হয় না। মূলত ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড়ের গায়ের গন্ধ আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করে ফেরোমন লিওর তৈরি করা হয়। ফোরোমন লিওরে থাকে ক্ষতিকর স্ত্রী পোকার গায়ের গন্ধ। এতে ওই জাতের পুরষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে ট্র্যাপ অর্থাৎ ফাঁদে পড়ে। পুরুষ পোকা মারা যাওয়ায় ক্ষতিকর পোকাগুলোর বংশ বিস্তার হয় না। এতে রক্ষা পায় কৃষকের রক্তে ঘামে উত্পাদিত কাঙ্ক্ষিত ফসল।

গাংনী উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মাজেদুল ইসলাম জানান, সবজির মধ্যে বেগুনের পোকা দমনে সবচেয়ে ক্ষতিকর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। এর মধ্যে ভলিউম ফেলাক্সি ও প্রোক্লেম গ্রুপের কীটনাশক অন্যতম। বেগুনের প্রধান শত্রু মাজরা পোকার কিড়া। পোকাগুলো বেগুন ও গাছের ডগা ছিদ্র করে। এতে বেগুনের ফলন ব্যাপকহারে কমে যায়। এ পোকা দমনে চাষিরা ক্ষতিকর কীটনাশক স্প্রে করেন। এ ধরনের বেগুন খেলে মানবদেহে ক্যান্সার ও ব্রেন স্ট্রোকসহ কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাছাড়া আমাদের দেশের সবজির গুণগত মান বিচারে দেশের বাইরে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শুধু অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে রফতানি হয় না।

সবজি ও ফল উৎপাদনে বিষমুক্ত পদ্ধতি ব্যবহার সম্প্রসারণ হচ্ছে জানিয়ে মুজিবনগর উপজেলা কৃষি অফিসার মুফাখখারুল ইসলাম বলেন, বেগুনে বিষ প্রয়োগের ৩০-৪০ দিন পর্যন্ত বিষের কার্যকারিতা থাকে। এ সময়ের মধ্যে বেগুন খাওয়া ঠিক না। কিন্তু আমাদের এলাকার চাষিরা সকালে ক্ষেতের বেগুনে বিষ প্রয়োগ করে বিকেলে হাটে তোলেন। তাই বিষমুক্ত সবজি পাওয়ার লক্ষ্যে সেক্স ফেরোমন ট্যাফে ব্যবহার সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে। এ পদ্ধতিতে ফসলের উপকারী পোকা যেমন-লেডি বার্ড বিটল ও মাকড়সা রক্ষা করা যায়। এতে ফসল উৎপাদন বাড়ে। বিষমুক্ত সবজি একদিকে যেমন মানবদেহের জন্য বিকল্প নেই তেমনি এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে উপকারী কীটপতঙ্গ রক্ষার মধ্যদিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব।

Leave a comment