টঙ্গির তুরাগ তীরে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। উপস্থিত মুসল্লিদের জিকির-আজকারে মুখরিত ইজতেমা ময়দান। মুসল্লিগণ ইজতেমা ময়দানে গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করেছেন। প্রসঙ্গত, ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ২০১১ সাল থেকে দু পর্বে ইজতেমা সম্পন্ন করার রীতি চালু করা হয়। প্রথমপর্বভূক্ত করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়াসহ দেশের ৩২টি জেলা। দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ বাকি জেলাগুলো। ইজতেমা তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সমাবেশ। ১৯৪৬ সাল থেকে তাবলিগ জামাতের ঐতিহাসিক সমাবেশ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মুসলিম জাহানে এটা দ্বিতীয় বৃহত সমাবেশ বললে ভুল বলা হয় না। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি নিঃসন্দেহে গৌরবের। দেশ ও বিদেশের লাখ লাখ মুসলিম নারী ও পুরুষ প্রতি বছর এ সমাবেশে যোগ দেন।
তাবলিগ জামাত শৃঙ্খলা এবং পরহেজগারির এক অনন্য কার্যক্রম। কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম- ইসলামের দাওয়াত দেয়া। ভ্রাম্যমাণ শিক্ষালয় বললেও ভুল বরা হয় না। সারা বছর তাবলিগ জামাতের মুসল্লিরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে এক মসজিদ থেকে আরেক মসজিদ পরিভ্রমণ করেন। মুসল্লিগণ সাংসারিক ও বৈষয়িক কর্মব্যস্ততা পরিহার করে দীনি অর্থাৎ ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন ও চর্চায় নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি ইসলামের পথে আসার আহ্বান জানান। বাড়ি বাড়ি গিয়েও মুসল্লিরা আল্লাহর পথে আহ্বান করেন। ইসলামী পরিভাষায় এরা দাওয়াতি কাজে আত্মনিয়োগ করে থাকেন। তাবলিগ জামাতের মুসল্লিরা ঘুম-খাওয়াসহ জীবনের সব কাজই করেন যথাসময়ে ও সুশৃঙ্খলভাবে। অন্যের প্রতি কতোটা যত্নবান হতে হয় তারও শিক্ষা দেন। জীবনের সব কাজকেই তারা ইবাদত বিবেচনা করেন এবং আল্লাহর স্মরণ হতে গাফেল না হওয়ার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকেন। ধনী-গরিব তথা নির্ধন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেই তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে দাওয়াতি কাজে মেহনত করতে পারেন। নামাজ-রোজা ছাড়াও ইসলাম সম্মত সুন্দর জীবন প্রণালীর শিক্ষা এবং তার অব্যাহত অনুশীলনে থাকেন তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারী মুসল্লিগণ। তাবলিগ জামাত কারও ওপর জোর-জবরদস্তি করে না। যাদের পক্ষে যতোটুক সময় দেয়া সম্ভবপর হয়, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই সময়টুকুই দেন দীনি-দাওয়াতের কাজে। এমনও অনেকে আছেন, যারা জীবনের বেশিরভাগ সময়ই দাওয়াতের কাজে ব্যয় করেন।
নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না, বিশ্ব ইজতেমা তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সমাবেশ। সর্বস্তরের মুসলমানগণ শরিক হন। ইজতেমার তিনদিনের প্রতি মুহূর্ত ব্যয় হয় ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকার এবং বয়ানের মাধ্যমে। তাবলিগ জামাতের ইতিহাস শতবর্ষের। হিজরি ১৩৪৫ সনে মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলবি (র.) তাবলিগ জামাতের সূত্রপাত করেন। গাশ্ত অর্থাৎ মসজিদ থেকে বের হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নামাজ ও কালেমার দাওয়াত পৌঁছে দেয়া শুরু করেন। মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবির (র.) মৃত্যুর পর তাবলিগ জামাতের মুবান্নিগের দায়িত্ব লাভ করেন তার সুযোগ্যপুত্র মাওলানা ইউসুফ কান্ধলবি (র.)। গত শতাব্দির মধ্যভাগে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সেই সময়েই এ সম্মেলনের কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নেয়া হয়। অবশ্য এর আগে ১৯৪১ সালে প্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় দিল্লীর নিজামউদ্দিন মসজিদ প্রাঙ্গণে। পরবর্তীতে, ১৯৪৬ সনে ঢাকাস্থ কাকরাইল মসজিদ প্রাঙ্গণে ইজতেমা হয়। ১৯৪৮ সনে চট্টগ্রামে, ১৯৫৮ সনে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এবং ১৯৬৬ সনে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয় টঙ্গির পাগার গ্রামে। অতঃপর ১৯৬৭ সন থেকে তুরাগ পাড়ের ময়দানে নিয়মিত বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বিশ্ব ইজতেমা সার্থক-সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার জন্য বরাবরের মতো এবারও যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনির্দিষ্টকালের অবরোধ বিশ্ব ইজতেমাগামী ধর্মপ্রাণ মসুল্লিদের অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে। অবশ্য পরে অবরোধ আর বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আল্লাহু তায়লা বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনকে কবুল করুন। ইজতেমায় মুসল্লিগণের আসা-যাওয়া এবং ইজতেমা ময়দানে অবস্থানের প্রতিটি মুহূর্ত নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হোক। সার্থক হউক তাদের এ মেহনত। কবুল হোক দোয়া। দূর হোক হিংসা হানাহানি। আমাদের দেশসহ গোটা মসুলিম জাহানে প্রতিষ্ঠা পাক শান্তি, বয়ে আনুক সমৃদ্ধতা। আমিন।