বিদ্যালয় চত্বরে আনন্দ উল্লাস : বাড়ি বাড়ি উৎসববঞ্চিত শিক্ষার্থীদের মুখভার-কান্না

বর্ণাঢ্য আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উসব উদযাপন

 

ব্যাগ টিশার্ট ক্যাপ খাবার এলো সৌজন্যে স্মরণিকা প্রকাশ বিজ্ঞাপনে : আয়ের এতো টাকা গেলো কোথায়?

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল শনিবার উৎসবকে ঘিরে কয়েকটি প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় বিদ্যালয় চত্বর। বিদ্যালয়ের নতুন-পুরোনো শিক্ষার্থীদের কাছে শতবর্ষ পূর্তি উৎসব প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়। তবে কিছু ঘটনা, কিছু প্রশ্ন অনেকটা মিলান করে দেয় শতবর্ষ পূর্তি এই উৎসবকে।

DSC05890

অন্যদিকে শুধু আর্থিক কারণে বিদ্যালয়ের প্রায় এক হাজার নিয়মিত ছাত্রী শতবর্ষ পূর্তি উদযাপনের এই উৎসবে অংশ নিতে না পারায় বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের কান্না আর মুখভার এবং অভিভাবকদের অসহায়ত্ব নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন উজ্জ্বলের একনায়কত্ব আচরণ, উৎসব উপলক্ষে গঠিত কমিটির সদস্যদের অবমূল্যায়ন ও আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন হাজারো শিক্ষার্থী-অভিভাবক-সুধীমহলের মুখে মুখে। বখাটেদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের বিষয়টি প্রশংসিত হলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বেহায়াপনা ও ছাত্রীদের ভেতরে ঢুকে অশ্লীল ভঙ্গিতে নাচ করার বিষয়টি সহজভাবে নেননি অভিভাবকসহ উপস্থিত সুধীজনেরা।

গতকাল শনিবার আবহাওয়া অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা রেকর্ড করে সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাত থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো ঘন কুয়াশা অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ। সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে বর্ষপূর্তির এই উৎসবে যোগ দিতে অংশগ্রহণকারী ছাত্রীরা সকাল ৭টা থেকে বিদ্যালয় চত্বরে আসতে থাকে।

পূর্ব নির্ধারিত প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, সভাপতি জেলা প্রশাসক মো. দেলোয়ার হোসাইন, বিশেষ অতিথি সংসদ সদস্য শিরিন নাঈম পুনম, পুলিশ সুপার মো. রশীদুল হাসানের অনুপস্থিতিতেই সকাল ৯টায় আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। জাতীয় ও উৎসবের পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মল্লিক সাঈদ মাহবুব জাতীয় পতাকা ও চুয়াডাঙ্গা পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার উৎসবের পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলনের পর বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়ে চুয়াডাঙ্গা শহর প্রদক্ষিণ শেষে একই স্থানে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা বাদ্যের তালে তালে নেচে মাতিয়ে তোলেন।

শোভাযাত্রা শেষে বিদ্যালয় চত্বরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মল্লিক সাঈদ মাহবুবের সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন উজ্জ্বল। অতিথির বক্তব্য রাখেন পৌর মেয়র রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, সহকারী পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা খোন্দকার রুহুল আমীন, উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুল হক বিশ্বাস ও সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মিসেস ইলা হক।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সাবেক প্রধান শিক্ষক ১৯৬২ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থী সফুরা খাতুন, একই ব্যাচের শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা খুলনা অঞ্চল, খুলনার সাবেক উপপরিচালক মৌছুফা বেগম, চুয়াডাঙ্গা ঝিনুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক রাশিদা হাসনু আরা, ১৯৬৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী সাবেক শিক্ষিকা রহিমা খাতুন, ১৯৭৭ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দিল আফরোজ জাহান, ১৯৮২ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ইসমত আরা শাহীন, ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা, ১৯৮৫ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থী ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক সালমা শাহ নওয়াজ, ১৯৮৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী চুয়াডাঙ্গা ওল্ড জিএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ জেবিন বন্যা, ১৯৮৭ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থী ওয়েভ ফাউন্ডেশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী নুঝাত পারভীনসহ সাবেক শিক্ষার্থীরা স্মৃতিচারণ করেন। এ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ১৯৯৮ সালের ব্যাচের শিক্ষার্থী নৃত্য, আবৃত্তি ও অভিনয় শিল্পী কামরুন নাহার ইতি, ২০০৪ সালের ব্যাচের শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খন্দকার নুসরাত জাহান করবী, ২০১২ সালের ব্যাচের যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাশমিনা ফারদিন সূচনা ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিরিন মেহনাজ তৃষ্ণা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে দশম শ্রেণির ছাত্রী নাফিছা তাবান্নুম মীম ও পবিত্র গীতা পাঠন করে প্রাক্তন ছাত্রী সৌম্যজিতা শ্রুতি।

আলোচনা পর্বের পর মধ্যাহ্নভোজের বিরতি শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর, কনক চাঁপা ও চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান শফিক তুহিন ও তার ভাই জাহাঙ্গীর হোসেনসহ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।

এদিকে অনুষ্ঠান চলাকালে ভেতরে প্রবেশ সংরক্ষিত থাকার কারণে শ শ অভিভাবককে কনকনে হিমেল হাওয়া আর যানবাহনের হর্ন ও ধুলোবালি উপেক্ষা করেই রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে তাদের সন্তানদের জন্য।

গতকাল অনুষ্ঠান চলাকালে একাধিক অভিভাবক মাথাভাঙ্গা দপ্তরে ফোন করেন। যাদের বেশির ভাগেরই কণ্ঠে ছিলো ক্ষোভ আর হতাশা। সন্তানদের ভবিষ্যত জটিলতার কথা বিবেচনা করে কোনো অভিভাবকই তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, কথিত নিবন্ধনের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৫০০ টাকা করে নেয়া হলেও খরচের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তারা জানান, নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে একটি করে ব্যাগ, ক্যাপ, টি শার্ট, স্মরণিকা, সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার দেয়া হয়েছে। ব্যাগ দেয়া হয়েছে বেস্ট ইলেক্ট্রনিক্সের সৌজন্যে, টি শার্ট বঙ্গজ লিমিটেডের সৌজন্যে, ক্যাপ আকিজ সিমেন্টের সৌজন্যে, দুপুরের খাবার হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের সৌজন্যে এবং বিজ্ঞাপনের টাকায় স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন বাকি থাকলো সকালের নাস্তা, সাজসজ্জা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের খরচের বিষয়টি। এ খরচের চেয়েও বেশি টাকা নানাভাবে উত্তোলন করা হয়েছে।

সূত্রমতে জেলা বিএনপির ১নং যুগ্মআহ্বায়ক মাহমুদ হাসান খান বাবু একাই দিয়েছেন দেড় লাখ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অঙ্কের টাকা প্রদান করেছেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টাকার বিনিময়ে ভাউচার প্রদান না করায় টাকা প্রাপ্তির পরিমাণ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

অনুষ্ঠানকে ঘিরে একাধিক উপকমিটি গঠন করা হলেও একটি কমিটিরও সভা করা হয়নি। প্রকাশনা কমিটির সদস্য রাজীব হাসান কচি ও সাজসজ্জা কমিটির সদস্য শাহ আলম সনি জানান, সুনির্দিষ্টভাবে কমিটির একটি বৈঠকও হয়নি। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন বলেছেন, এ পর্যন্ত নয় লাখ টাকা আয় এবং অনুষ্ঠান বাবদ ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। যা পুরোই অস্বাভাবিক বলে অনেকেই মনে করেন। ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের দাবি, অনুষ্ঠান পরবর্তী সময়ে মূল্যায়নসভা করে গোটা আয়-ব্যয় ও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত করার বিষয়টি আলোচনা হওয়া জরুরি বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।