স্টাফ রিপোর্টার: চারদিকে ছড়ানো ছেটানো নানা রকম যন্ত্রপাতি। চোখে-মুখে ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন একদল কর্মী। আশপাশে উপচে পড়ছে মানুষ। থেকে থেকে আহাজারি করে উঠছে তারা। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে সবকিছু। সবার মনোযোগ একটি পাইপের সরু গর্তের দিকে। কারণ, বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে সেখানে পড়ে গেছে জিয়াদ নামের একটি শিশু। বয়স তার সাড়ে তিন বছর। সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা- বাঁচবে তো ছেলেটি? উদ্ধার করা যাবে তো? এখনো কী বেঁচে আছে? এসব প্রশ্নের জবাব জানতেই গতরাত ২টার দিকে নামানো হয় অত্যাধুনিক ক্যামেরা। ক্যামরোয় তেলাপোকা ও পরিত্যক্ত পাদুকাসহ টিকটিকির অস্তিত্ব ধরা পড়লেও শিশুর অস্তিত্ব রাত ৩টা পর্যন্ত না মেলায় উদ্ধারকারীদের কেউ কেউ পাইপে শিশু পড়ার ঘটনাকে গুজব বলে দাবি করেন। তবে শিশু জিয়াদ কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব মেলেনি। সে কারণেই ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পাইপের নিচে পড়া আবর্জনা সরিয়ে শিশুর অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ওয়াসার অত্যাধুনিক ক্যামেরা নামিয়ে জীবিত বা মৃত শিশুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এরপরও শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য উদ্ধার কাজ ফায়ার স্টেশনের সদস্যরা চালিয়ে যাবেন।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠের কাছে অরক্ষিত ও পরিত্যক্ত গর্তটিতে পড়ে যায় শিশুটি। বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। উদ্ধারকাজে জড়িতদের দাবি, গর্তটির গভীরতা ৪০০ থেকে ৬০০ ফুট, ব্যাসার্ধ ১৭ ইঞ্চি। আবার এ পাইপের মধ্যে দু ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ছোট আরেকটি পাইপ রয়েছে। ফলে কূপটির ব্যাসার্ধ ১৪ থেকে ১৫ ইঞ্চিতে দাঁড়িয়েছে। গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গর্ত থেকে জিয়াদকে উদ্ধারের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা।
উদ্ধারকারীরা বলেছেন, বিকেল ৪টা থেকে উদ্ধারকাজ শুরুর পর কয়েকবার জিয়াদের সাড়া পাওয়া গেছে। গর্তে পড়ে যাওয়ার আট ঘণ্টা পর রাত ১২টা পর্যন্ত আশা করা হচ্ছিলো, জিয়াদ বেঁচেই আছে। গর্তটি সরু হওয়ায় ভেতরে দড়ি দিয়ে কৌশলে উদ্ধারের চেষ্টা চলে দীর্ঘ সময়। দড়ি ফেলা হলে চার বার জিয়াদ সেই দড়ি ধরে উঠতে চেয়েছিলো বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তবে একপর্যায়ে দড়ি ছেড়ে দেয় শিশুটি। শেষে ক্রেন দিয়ে ভেতরের পাইপটি কেটে ওঠানো হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ভেতরের পাইপটি ওঠানোর পরেও জিহাদের সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে উদ্ধারকারীরা বলেন, জিয়াদ তখনো বেঁচে ছিলো। রাত পৌনে ১২টার দিকে বশির আহমেদ নামের এক স্বেচ্ছাসেবী গর্তে নামার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে তাকে ভেতরে নামার অনুমতি দেয়া হয়নি। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ভেতরে ক্যামেরা ও দড়ি ঢুকিয়ে জিয়াদের অবস্থান শনাক্ত করার চেষ্টা চলছিলো।
জিয়াদের পরিবারসহ স্থানীয়রা তাকে জীবিত উদ্ধারের দাবিতে সরব ছিলো। ঘটনাস্থলে ভিড় করা উৎকণ্ঠিত মানুষ বিপদগ্রস্ত শিশুটির জন্য আহাজারি করে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা করবেন। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার টিমের প্রধান মেজর শাকিল নেয়াজ রাত সাড়ে ৯টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বিভিন্ন কৌশলে চেষ্টা করছি। নট সিস্টেমে বিশেষ করে রশি ও চটের বস্তা ফেলা হয়েছে। তবে কূপটির গভীরতা প্রায় ৬০০ ফুটের কাছাকাছি হবে। কূপের ব্যাসার্ধ কম হওয়ায় উদ্ধারে ঝামেলা হচ্ছে। এখন ক্রেন ব্যবহার করা হচ্ছে।
জিয়াদের বাবা নাসিরউদ্দিন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নিরাপত্তাকর্মী। তিনি পরিবার নিয়ে শাহজাহানপুর কলোনি এলাকায় থাকেন। তার তিন সন্তান। নাসিরউদ্দিন জানান, বিকেল ৩টার দিকে খিলগাঁও কলোনি মাঠের পাশে দু বন্ধুর সাথে খেলছিলো জিয়াদ। হঠাৎ সে খোলা গর্তে পড়ে যায়। বন্ধুরা চিৎকার করে উঠলে প্রথমে স্থানীয়রা জিয়াদকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। খবর দেয়া হলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আসেন।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (ঢাকা) রফিকুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট বিকেল ৪টার দিকে উদ্ধারকাজ শুরু করে। গর্তটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিলো। গভীরতা ৪০০ থেকে ৬০০ ফুট বলে জানা গেছে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রফিকুল ইসলাম বলেন, ভেতরে দড়ি ফেলা হলে চারবার শিশুটি দড়ি ধরে। তবে ভার সামলাতে না পেড়ে হয়তো ছেড়ে দিয়েছে। তাকে জুস দেয়া হয়েছে। দড়িতে বেঁধে ভেতরে দুটি টর্চলাইটও পাঠানো হয়েছে। রাত ৮টা পর্যন্ত আমরা তার সাড়া পেয়েছি। আশা করছি সে বেঁচে আছে।
শিশুটির গর্তে পড়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল থেকেই উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে ভিড় করে। সন্ধ্যায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরাসরি উদ্ধারকাজ সম্প্রচার শুরু করে। রাতে শীত উপেক্ষা করে আশপাশের হাজার হাজার মানুষ সেখানে যায়। ভিড় করেন সংবাদকর্মীরাও। ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও পুলিশ উদ্ধারকর্মীরা জানান, ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়। গর্তটির মধ্যে একটি ছোট পাইপও আছে। ফলে সেখানে কোনো মানুষ নামা সম্ভব নয়। এ কারণে উদ্ধারকারীরা প্রথমে দড়ি ফেলে জিয়াদকে উদ্ধারের চেষ্টা করে। পাঁচবার ভেতরে দড়ি ফেলা হয়েছে। চারবার দড়ি ধরলেও তা আঁকড়ে থাকতে পারেনি জিয়াদ। এরপর দড়ির সাথে চটের বস্তা ফেলা হয়েছে। রাত ৮টা পর্যন্ত সে ডাকে সাড়া দিয়েছে। বারবার তাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। উদ্ধারকর্মীরা আরো জানান, কূপের ব্যাসার্ধ কম হওয়ায় কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। তবে শিশুটির সাথে কয়েক দফা কথা বলা সম্ভব হয়েছে। ডাকলে সে সাড়া দিচ্ছে। শাহজাহানপুর থানার ওসি মেহেদী হাসান ঘটনাস্থল থেকে বলেন, গর্তটি এক বছরের মতো পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। শিশুটিকে জীবিত উদ্ধারের প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছি আমরাও। স্থানীয়রা অভিযোগ করে, ওয়াসার নির্মাণাধীন পাম্পের জন্য ওই জায়গায় গভীর গর্ত করা হয়েছিলো। পরে তা অরক্ষিত রেখেছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানী ঢাকার শাহজানপুরের রেলওয়ে মাঠ সংলগ্ন পরিত্যক্ত পানির পাম্পে শিশু পড়ে যাওয়ার ঘটনায় সেখানকার প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে বরখাস্ত করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। একই সাথে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসআর হাউসকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।