নীরব বিষে ১০ বছরে নারী-পুরুষসহ আক্রান্ত অসংখ্য : ২৬ জনের মৃত্যু

চুয়াডাঙ্গার বড় দুধপাতিলা গ্রামে আর্সেনিকের ভয়াবহ ছোবল : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর উদাসীন

 

স্টাফ রিপোর্টার: পানির অপর নাম জীবন। আর সেই পানিই এখন মৃত্যুর বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলার বড় দুধপাতিলা গ্রামের মানুষের। অনেকটা জেনে শুনেই আর্সেনিকযুক্ত বিষপান করছেন ওই গ্রামে বসবাসকারী প্রায় ৬ হাজার মানুষ। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো আর্সেনিক রোগে গ্রামটিতে গত ১০ বছরে ২৬ জন নারী-পুরুষ মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সহস্রাধিক। তারপরও টনক নড়েনি চুয়াডাঙ্গা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের। যদিও তাদের বক্তব্য আর্সেনিক নিয়ন্ত্রণে তারা কাজ করেছেন। তবে গ্রামবাসী এ বক্তব্য মানতে নারাজ।

চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার হাউলী ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বড় দুধপাতিলা গ্রাম। গ্রামটির প্রায় ৬০০টি পরিবারের প্রায় ৬ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু জেনে শুনে আসের্নিকযুক্ত পানি পান করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কারণ গ্রামটির প্রতিটি বাড়ির নলকূপের পানিতেই রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক।

আর তাই তো নিশ্চিত মৃত্যু ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সেই বিষযুক্ত পানি গোসল রান্না-বান্না খাওয়াসহ সব কাজেই ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে গ্রামটির মানুষ। গ্রামবাসীর বক্তব্য, বড় দুধপাতিলা গ্রামে প্রায় ৬০০টি পরিবার বসবাস করে। প্রতিটি বাড়ির নলকূপের পানিতেই রয়েছে আর্সেনিক। আর তাই তো উপায় না পেয়ে সেই পানিই ব্যবহার করছেন তারা। ফলাফল গ্রামটিতে প্রতিদিনই আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।

বড় দুধপাতিলা গ্রামে গত ১০ বছরে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গ্রামের কেউ বাবা, কেউবা মা আবার কেউ প্রিয় সন্তানকে হারিয়েছেন। গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আকতারুল হোসেন জানালেন, আর্সেনিকের ভয়াল ছোবলে ১০ বছর আগে তার পিতা আহসান মণ্ডল ও চাচা মোহাম্মদ আলী মারা গেছে। তার মতে, গ্রামের অনেকেই পরিবারের প্রিয় সদস্যকে হারানোর পরও উপায়ান্তর না পেয়ে সেই আর্সেনিকযুক্ত পানিই ব্যবহার করছেন। সালমা নামে এক গৃহবধূ গণমাধ্যম কর্মী পরিচয় পেয়ে অনেকটা ক্ষোভের সাথেই বললেন, প্রতিবছরই সাংবাদিকরা আসেন, আমাদের ছবি নেন, কিন্তু আমাদের ভালো পানির ব্যবস্থা করেন না। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রিসোর স্থানীয় উন্নয়ন কর্মী আব্দুস সালাম জানান, তাদের হিসাবমতে বড় দুধপাতিলা গ্রামে আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে মারা গেছে ২৫ জন। এখনো আক্রান্ত রোগী সংখ্যা ৪ শতাধিকেরও বেশি। সবচেয়ে আতঙ্ক ও উদ্বেগের খবরটি হলো আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে গত ১০ বছরে গ্রামটিতে আব্দুল মান্নান, ইব্রাহিম, মুনছার আলী আমজাদ হোসেন, আফসার আলী ও সফুরা বেগমসহ ২৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। তারপরও টনক নড়েনি স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ কিংবা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের। একই সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এগিয়ে আসেননি আক্রান্ত মানুষদের পাশে। এ নিয়ে সাধারণ গ্রামবাসীর ক্ষোভও অনেক।

হাউলী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী শাহ মিন্টু জানালেন, আক্রান্ত রোগীদের সচেতনতা সৃষ্টিকরাসহ তাদের মাঝে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওষুধ বিতরণ করে আসছেন তারা।

চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর জানান, গত মেয়াদে জাতীয় সংসদে দুধপাতিলা গ্রামটির আর্সেনিকের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলাম। কিছু কাজও হয়েছে। বর্তমান বিষয়টি সরেজমিনে দেখতে আমি এসেছি। তিনি গ্রামবাসীদের আশ্বস্ত করে বলেন, আর্সেনিক মোকাবেলায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। দুধপাতিলা গ্রামের আর্সেনিক নিয়ে চুয়াডাঙ্গা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ওমর আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, দুধপাতিলা গ্রামের আর্সেনিক মোকাবেলায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু গ্রামবাসীর অসহযোগিতার কারণে সেই সেটির সুফল তারা পায়নি। দুধপাতিলা গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছে রিসো নামে একটি বেসরকারি এনজিও সংস্থা। সংস্থাটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহায়তায় ও এনজিও ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে গ্রামটিতে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।