সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ এবং আমাদের বাস্তবতা

সব অপহরণের অভিযোগ যেমন সঠিক নয়, তেমনই অপহরণের কোনো অভিযোগ নিয়েই হেলাফেলা করা উচিত নয়। অপহরণের নাটক সাজিয়ে কেউ কেউ প্রতিপক্ষকে মামলায় ফাঁসানোর যেমন অপচেষ্টা চালায়, তেমনই দায়গ্রস্ত কেউ কেউ পাওনাদারদের টাকা আদায়ের চাপ থেকেও সাময়িক রেহাই পাওয়ার জন্য অপহরণের নাটক সাজায়। এরকম নাটকের বহু উদাহরণ যেমন রয়েছে, তেমনই অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় এবং মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যার উদাহরণও কম নয়। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে অপহরণের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদাপুরে একজনকে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অপরদিকে মেহেরপুর গাংনীর পল্লি থেকে এক কলেজছাত্রকে অপহরণ করা হয়। এ অপহরণ রহস্য উন্মোচন হয়নি। চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের বদরগঞ্জ এলাকার এক গ্রামের স্কুলছাত্রকে কৌশলে অপহরণের পর আলমডাঙ্গার পল্লিতে আটকে রাখা হয়। তাকে কবরস্থানে বন্দী করে রাখার কয়েক দিনের মাথায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। অপহরণের এ ঘটনাই প্রথম নয়। ইতঃপূর্বেও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। অপহৃতকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপণ দেয়ার পরও জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি অনেকের। আবার কবে কখন কে যে অপহরণের শিকার হবে, তার পরিবারের সদস্যদের পড়তে হবে অনিশ্চয়তার মধ্যে কে জানে? বাঘা বাঘা সন্ত্রাসীদের পতন হয়েছে। এরপরও সমাজ কেন সন্ত্রাসমুক্ত হলো না? উন্নয়নশীল দেশে সন্ত্রাস নির্মূলের স্বপ্ন অবান্তর হলেও সন্ত্রাস দমন অসম্ভব নয়। সন্ত্রাসমুক্ত সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের দায়িত্বশীলতা ও এলাকায় পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান গড়ে তোলার বিশেষ উদ্যোগ।

নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, এক সময়ের সন্ত্রাস কবলিত জনপদে চরমপন্থি নামধারী অবৈধ অস্ত্রধারীদের অস্ত্রের ঝনঝনানি এখন নেই। আছে চাঁদাবাজ, ডাকাত, ছিনতাইকারী, অপহরকচক্রসহ চোর। একের পর এক ডাকাতির খবর পত্রিকার পাতায় উঠে আসছে। অনেক খবর আড়ালেও রয়ে যাচ্ছে। অপহরণেরও সব খবর পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পাচ্ছে না। নানা শঙ্কায় অপহৃতকে উদ্ধার তৎপরতা গোপনেই চালানো হয়। চাঁদাবাজদের উৎপাতের সকল খবরও সব সময় সাংবাদিকেরা টের পান না। কারণ চাঁদাবাজির শিকার ব্যক্তি গোপনে আপস করে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে থাকে। থানায় নালিশ দুরস্ত প্রতিবেশীদের কাছেও গোপন রাখে চাঁদাবাজির শিকারের বিষয়টি। অপহরণের বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে গোপন করা হয় অপহৃতকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাওয়ার আশায়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন, গোপন করে বা চাঁদাবাজ অপহরকচক্রের সাথে আপস কী অপরাধীদের অপতৎপরতাকে উসকে দেয়া নয়? কেউ কেউ পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলতেই পারেন, পুলিশে নালিশ করে কতোটা প্রতিকার মিলেছে? মেলে, মেলে না। এরপরও পুলিশই তো ভরসা। পুলিশের সকল অফিসার তো আর এক নন। গোপনে সন্ত্রাসীদের সাথে আপস মানে তাদেরকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলতে উৎসাহিত করা। যার কুফল থেকে গোপনকারীও পরবর্তীতে মুক্ত থাকতে পারেন না।

অবশ্যই পুলিশি তৎপরতা জোরদার করা দরকার। পুলিশের আন্তরিকতা এলাকাবাসীকে শুধু সাহসী করে না, অপরাধীদের সম্পর্কে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করারও মানসিকতা গড়ে তোলে। অবশ্য কখনো কখনো পুলিশকে সহযোগিতা দূরের কথা, চাঁদাবাজির শিকার হওয়ার পরও পুলিশে নালিশ করতেও তেমন আগ্রহ দেখান না। আড়ালে তদন্ত এবং অপরাধী ধরতে গড়িমসি। পুলিশকে জনগণের সহযোগিতার মতো তৎপর হওয়া যেমন দরকার, তেমনই জনগণকেও এলাকার অপরাধী সম্পর্কে গোপনে তথ্য দিয়ে সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।